ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক |
লেখক-:মতি নন্দী
লেখকের পরিচিত :- মতি নন্দী (১০ জুলাই ১৯৩১ - ৩ জানুয়ারি ২০১০) ছিলেন ভারতের কলকাতার একজন বাঙালি লেখক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মতি নন্দী ছিলেন মূলত ক্রীড়া সাংবাদিক এবং উপন্যাসিক ও শিশু সাহিত্যিক। তিনি আনন্দ পুরস্কার এবং সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছেন। তার বিখ্যাত উপন্যাস 'কোনি'। লেখকের সম্বন্ধে আরো পড়ুন
ক্ষিতীশ সারা সকাল অ্যাপােলােয় অপেক্ষা করেছে , কোনি আজও আসেনি । গত দু - সপ্তাহে একবেলাও সে কামাই করেনি । ক্ষিতীশ ভয়ে রয়েছে , এই বুঝি কস্টুম দাবি করে বসে । এখনাে সে সমানে বলে যাচ্ছে , “ হয়নি হয়নি , ইঞ্চিখানেকের বেশি জল থেকে হাত উঠবে না । ... অতটা পাশের দিকে হাত যাচ্ছে কেন – ওকি , দুটো হাত ঠিকমতাে সমানে চলছে না কেন ? ”
বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিতীশ মাথা নাড়ে । আর ভাবে কস্টুম আজই কিনতে হবে দেখছি । কখনাে কখনাে সে জলে নেমে সাঁতার কেটে স্ট্রোক দেখিয়ে দেয় । ওদের পাশ দিয়েই অন্যরা সাঁতার কেটে যায় , বেলা গড়িয়ে যায় , কমলদিঘির জল জনশূন্য হয়ে আসে । কোনি যখন বিরক্ত হয় ওঠে, ক্ষিতীশ বলে , “ দাদার কাছে তাে খুব ঘাড় নেড়েছিলিস ! ভিকট্রি স্ট্যান্ডে ওঠা খুব সহজ ব্যাপার ভেবেছিস । রেকর্ড করাটা গঙ্গায় আম কুড়ােনাে নয় , বুঝলি ? ” ফেরার পথে গল্প করেছে পৃথিবীর বড়াে বড়াে সাঁতারুর , তাদের আন্তরিকতার , নিষ্ঠার , পরিশ্রমের ।
অপেক্ষা করে অবশেষে ক্ষিতীশ বেরিয়ে পড়ল অ্যাপােলাে থেকে । বিষ্টু ধরের বাড়ি পৌছাল মিনিট দশেকের মধ্যে । তাকে দেখেই বিষ্টু ব্যস্ত হয়ে বলল , “ এই একটু আগে দর্জিপাড়া বয়েজ লাইব্রেরির লােকেরা এসেছিল ওদের অ্যানুয়াল সােশ্যালে চিফ গেস্ট করার জন্য । প্রেসিডেন্ট হবে কে জানেন ? ঐ বিনােদ ভড় । আমি রাজি হয়ে গেছি । ওখানে দারুণ একটা ইস্পিচে ওকে ডাউন দিতে হবে । বুঝলেন , ক্ল্যাপ ওকে পেতে দেব না । ”
বিষ্টু ধরের উত্তেজিত মুখ দেখে ক্ষিতীশ চটপট মতলব ভেঁজে নিয়ে বলল “ শুধু একটা বক্তৃতায় ডাউন দিয়ে কী লাভ হবে । লােকে কিছুদিন মনে রেখে তাে ভুলে যাবে । তার থেকে এমন একটা কিছু দরকার , যাতে বিনােদ ভড় রেগুলার ডাউন খায় । ”
“ কী রকম ? ” বিষ্টু কৌতূহল দেখাল । “ রেগুলার ডাউন কীভাবে সম্ভব ? ”
“ ভাবতে হয়েছে , তিনদিন ধরে ভেবেছি । ” ক্ষিতীশ নিজেকে গুরুত্ব দেবার জন্য গলার স্বর ভারিক্কি করে তুলল । “ ভেবে দেখলম বিনােদ ভড় যে যে অর্গানাইজেশনে আছে , তার পাল্টাগুলােয় ঢুকতে হবে । ও যদি ড্রামা ক্লাবে থাকে , আপনাকেও ড্রামা ক্লাবে ঢুকতে হবে । ও যদি কোনাে হরিসভার পৃষ্ঠপােষক হয় , আপনাকেও একটি হরিসভায় ঘাঁটি করতে হবে । ও যদি কোনাে সুইমিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হয় ....
“ আছে । ” বিষ্টু ধর প্রায় চেঁচিয়ে উঠল , “ জুপিটারের প্রেসিডেন্ট বিনােদ ভড় । ”
ক্ষিতীশ মাথা হেলিয়ে বলল , “ আপনাকে জুপিটারের রাইভাল ক্লাবে ঢুকতে হবে । ”
“ সেটা তাে অ্যাপােলাে । কিন্তু ঢুকব কী করে ? ” বিষ্টু ধর বিমর্ষ গলায় বলল । “ পারেন একটা কিছু করে দিতে ? ”
“ চেষ্টা করতে হবে । আজও আমি নকুল মুখুজ্জের সঙ্গে কথা বলেছি । সাত হাজারের কমে রাজি হচ্ছে না । ”
“ সাত হাজার । মানে ? ”
“ মানে , প্রেসিডেন্ট হতে গেলে ডােনেশন তাে দিতে হবে । অমনি অমনি কি আর হওয়া যায় । বিনােদ ভড়ও তলায় তলায় চেষ্টা করছে ওর দাদাকে অ্যাপােলােয় ঢােকাবার জন্য । পাঁচ হাজার পর্যন্ত অফার করেছে । ”
“ কিন্তু সাত হাজার ! কমসম করা যায় না ? ”
“ কত কমাবেন ? পাঁচ হাজার অফার তাে পেয়েই গেছে । বিনােদ ভড় এম এল এ , মন্ত্রী হবারও চান্স খুব , ওকে তাে সবাই হাতে রাখতে চাইবে । আপনি যদি বেশি টাকা না দেন তাহলে ওদের লাভটা কী হবে বলুন ? ”
“ তা তাে বটেই । ” বিষ্ট ধর চিন্তিত হয়ে পেটে হাত বুলাতে লাগল ।
ক্ষিতীশ কিছুক্ষণ ওকে লক্ষ করে আবার বলল , “ দেরি করলে চলবে না । দু - একদিনের মধ্যেই ঠিক করে ফেলতে হবে । বিনােদের পার্টি উঠে - পড়ে লেগেছে । ”
“ বেশ সাত হাজারই দোব । কিন্তু .... ”
বিষ্টু ধরের কথা শেষ হবার আগেই চাকর ঘরে ঢুকে জানাল , একজন মাইজি দেখা করতে এসেছে ।
এরপর ক্ষিতীশকে অবাক করে ঘরে ঢুকল লীলাবতী । ক্ষিতীশকে এখানে দেখে সেও অবাক। তবে কোনাে কথা বলল না ।
“ টাকাটা এনেছি । ” লীলাবতী তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্যে বিষ্টু ধরাকে বলল ।
ব্যস্ত হয়ে বিষ্টু বলল , “ পাশের ঘরে আসুন , আপনার রসিদ - টসিদ সব রেডি করা আছে । ”
ওরা দুজন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এবং মিনিট পাঁচেক পরই বিষ্ণু একা ঘরে ফিরে এল । ক্ষিতীশ তখন কৌতূহলে ফেটে পড়ার মতাে অবস্থায় ।
“ কী ব্যাপার , কীসের টাকা ? ”
ওই একটা ঘর ভাড়া নেওয়ার ব্যাপার । হাতিবাগানে আমার একটা বাড়িতে এরা দোকান করবে টেলারিং শপ । তাই কিছু টাকা দিয়ে গেল । ”
পাচ হাজার টাকা ।
বিষ্টু ধর চমকে উঠল । “ কী করে জানলেন । ”
“ টাকাটা যার কাছ থেকে নিলেন , সে আমার স্ত্রী । ওর কাছ থেকে সেলামি নেওয়া মানে আমার কাছ থেকেই নেওয়া । ”
বিষ্টু ধর ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল ক্ষিতীশের গম্ভীর মুখ দেখে । তােতলা স্বরে বলল , “ আমি তাে তা জানতাম না । ”
“ আমিও জানতাম না আপনিই বাড়িওলা । যাই হােক , এবার আমরা দুজনেই জানলাম । জানার পর , আপনি কি টাকাটা এখন নেবেন ? ”
বিষ্টু আরাে তােতলা হয়ে গেল । “ ইয়ে এটা তাে ব্যবসার ব্যাপার . আমাকে তাে খেয়ে পরে বাঁচতে হবে । ”
ক্ষিতীশ উঠে দাঁড়াল । “ চলি । বিনােদ ভড় কোর্টে বেরিয়ে গেছে । তা রাত্তিরেই দেখা করব ওর সঙ্গে । ”
না না , প্লিজ যাবেন না । ”
“ হাজার দুয়েক টাকা ডােনেশন আর একটা নাইলনের কি বেলনের কস্টুম কেনার জন্য একশাে টাকা যদি দিতে পারেন তা হলে গ্যারান্টি দিচ্ছি অ্যাপােলাের প্রেসিডেন্ট করে দেবােই । তবে এই সেলামির টাকাটা ফেরত দিতে হবে । তাছাড়া বক্তৃতাও আমি আর লিখে দিতে পারব না । ”
বিষ্টু ধর চূর্ণ বিচূর্ণ । কথা বলার আর ক্ষমতা নেই । দুটি চোখ ছলছলিয়ে উঠেছে । শুধু মাথাটি নেড়ে বলল , “ গাছে অনেক দুর উঠে গেছি । মই কেড়ে নিলে নামতে পারব না । ”
বিষ্টু ধর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এবং একশাে টাকার নােটের বান্ডিল নিয়ে ফিরে , সেটা ক্ষিতীশের হাতে দিয়ে বলল , উনি আপনার স্ত্রী হন তাে ? ”
“ আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি ! ”
বিষ্টু জিভ কেটে কান মুলল । ক্ষিতীশ আর অপেক্ষা করল না । বেরিয়ে আসছে , তখন শুনল বিষ্টু কাতর কণ্ঠে বলছে , “ আমার বক্তৃতাটার কী হবে । ”
“ দেবাে দেবাে , লিখে দেবাে । ”
বাড়ি ফিরে ক্ষিতীশ নােটের বান্ডিলটা নিজের বাক্সে রেখে দিয়ে ভাবতে শুরু করল , এবার কী করবে । টাকাগুলাে লীলাবতীকে ফেরত দিতেই হবে , কিন্তু তার বিনিময়ে কিছু আদায় করে নিতে হবে । এবং তা করতে হবে কোনিরই জন্য ।
লীলাবতী বাড়িতে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করল , “ ওখানে তুমি কী করছিলে ? ”
“ মাঝে মাঝে যাই বুদ্ধি পরামর্শ দিতে । তুমি কেন গেছিলে ? ”
“ ওর কাছ থেকেই তাে ঘর নিয়েছি । সেলামির টাকাটা দিতে গেছলুম । ”
ক্ষিতীশ হাই তুলে , আড়মােড়া ভেঙে বলল , “ আগে যদি আমায় বলতে তাহলে টাকাটা দিতে হতাে না । আমি বারণ করলে বিষ্টু ধরের সাধ্যি নেই টাকা নেবার , তবে বললে টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবে । ”
“ দ্যাখাে না একবার বলে , অনেকগুলাে টাকা । দেবার সময় গা করকর করছিল । ” লীলাবতী ব্যগ্র হয়ে বলল ।
“ কিন্তু কোনিকে যে ওর বাড়িতেই খাওয়ার ব্যবস্থা করব ভাবছিলাম । এরপর কি অতগুলাে টাকা ফেরত দেবার কথা বলা যায় । মেয়েটাকে যে খাটাব , তার জন্য কিছু তাে করতে হবে । দাও গামছাটা , চান করে আসি । ”
বিকেলে লীলাবতী অন্য মূর্তি ধরে বলল , “ পরের মেয়ের জন্য তাে খুব মাথা - ব্যথা । আর আমি যে এত কষ্ট করে দোকানটা দাঁড় করালাম , তিল - তিল করে টাকা জমিয়ে ব্যবসাটা বড়াে করার চেষ্টা করছি , তাতে একটু সাহায্যও কি করবে না ! ”
ক্ষিতীশ বাড়ি থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাবার আগে শুধু বলে গেল ,“ আচ্ছা দেখছি । ”
অ্যাপপালােয় সারা বিকেল অপেক্ষা করল ক্ষিতীশ , কোনি এল না । নকুল মুখুজ্জের সঙ্গে দেখা হলাে ।
“ প্রেসিডেন্ট পেয়েছি , কত টাকা ডােনেশন চাও নকুলদা ? ”
নকুল একটু হকচকিয়ে বলল , “ কত টাকা মানে ? এখন বটুবাবু পাঁচশাে দিচ্ছে , তাও টিপে টিপে দেয় । ”
“ ঠিক আছে । আমি দু'হাজারি ধরেছি । ”
ক্ষিতীশ তারিয়ে তারিয়ে নকুল মুখুজ্জের অবস্থাটা লক্ষ করার পর বিষ্টু ধর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানিয়ে বলল , “ কিছু ভেব না তুমি , টাকা এসে যাবে । তবে আমার ওই মেয়েটার পুরাে ট্রেনিং ফেসিলিটি দিতে হবে কিন্তু । ”
নকুল মুখুজ্জে একগাল হেসে মাথাটা হেলিয়ে বলল , “ নিশ্চয় । ”
অ্যাপােলাে থেকে বেরিয়ে ক্ষিতীশ ভাবল , মেয়েটা কেন আজ এল না , একবার খোঁজ নেওয়া দরকার । বড় ফাঁকিবাজ । কিছুর একটা লােভ না দেখালে খাটতেই চায় না । তবে একটা দুর্বলতা আছে , সেটা ওর অপমানবােধ । ক্ষিতীশের প্রায়ই মনে পড়ে , প্রাইজ না নিয়ে লেক থেকে কোনির চলে আসা আর ঘুরে দাঁড়িয়ে তার বিজয়ীর নামটি শােনার সেই ভঙ্গিটি । দাদার কাছ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে অপরাধীর মতাে মুখ নীচু করে থাকা মেয়েটি হঠাৎ যেন দপ করে জ্বলে উঠেছিল ।
বস্তির মধ্যে আলাে নেই । ক্ষিতীশ একটু অসুবিধায় পড়ল ঘরটা খুঁজে বার করতে । অবশেষে একটা বাচ্চা ছেলে তাকে দেখিয়ে দিল । ঘরের মধ্যে কুপি জ্বলছে । কোনির ছােটো ভাই দুটো মেঝেয় ঘুমিয়ে । তক্তপােশে সম্ভবত ওর মা শুয়ে । ক্ষিতীশ ডাকল , “ কোনি । ”
ঘর থেকে নিঃশব্দে কোনি বেরিয়ে এল ।
“ ব্যাপার কী তাের । আজ যাসনি কেন ? এভাবে কামাই দিলে আর তাহলে যেতে হবে না । তাের দাদাকে আমি জানিয়ে দেবাে , হবে - টবে না কিছু তাের দ্বারা । ” বিরক্তস্বরে ক্ষিতীশ বেশ জোরেই কথাগুলাে বলল ।
কোনি কথা না বলে একইভাবে দাঁড়িয়ে । অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে
না ।
হঠাৎ ক্ষিতীশের পিছন থেকে খনখনে স্বরে কে বলে উঠল , “ কেমন লােক গা তুমি , কাল রাতে মেয়েটার দাদা মরে গেল আর তুমি এখন তাকে ধমকাতে নেগেছ ? ”
ক্ষিতীশ প্রথমে বুঝতে পারেনি সে কী শুনল । পিছনে তাকিয়ে বলল , “ কে মরে গেছে ? ”
“ জানাে না দেখছি ! কাল বিকেল থেকে মুখে অক্ত উঠল , ভলকে ভলকে , রাত্তিরেই কাবার । কোনির দাদা গাে ! ”
ক্ষিতীশ বার দুয়েক কেঁপে উঠল এবং শুনল কোনি খুব ক্লান্ত এবং শান্ত স্বরে বলছে , “ ক্ষিন্দা , এবার আমরা কী খাব ? ”