ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক |
লেখক :- মতি নন্দী
লেখকের পরিচিত :- মতি নন্দী (১০ জুলাই ১৯৩১ - ৩ জানুয়ারি ২০১০) ছিলেন ভারতের কলকাতার একজন বাঙালি লেখক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মতি নন্দী ছিলেন মূলত ক্রীড়া সাংবাদিক এবং উপন্যাসিক ও শিশু সাহিত্যিক। তিনি আনন্দ পুরস্কার এবং সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছেন। তার বিখ্যাত উপন্যাস 'কোনি'। লেখকের সম্বন্ধে আরো পড়ুন ।
গঙ্গায় একটা আম ভেসে চলেছে ভাটার টানে । তিনজন সাঁতরাচ্ছে সেটাকে পাবার জন্য । কোমর জলে দাঁড়িয়ে দু - তিনটি বছর চোদ্দো - পনেরাের ছেলে জল থাবড়ে হইচই করে ওদের তাতিয়ে তুলছে । সমানে - সমানে ওরা যাচ্ছে মাথা তিনটে দু - ধারে নাড়াতে নাড়াতে , কনুই না ভেঙে সােজা হাত বৈঠার মতাে চালিয়ে ওরা আমটাকে তাড়া করেছে ।
হঠাৎ ওদের একজন একটু একটু করে এগিয়ে যেতে শুরু করল , অন্য দুজনকে পিছনে ফেলে । তখনই চিৎকার উঠল “ কো ও ও ও..নি ই ই ই । কো ও ও ও . নি ই ই ই । ” পিছিয়ে পড়া দু - জনও গতি বাড়াল ।
আমটা প্রায় প্রথম ছেলেটির মুঠোয় এসে গেছে । হঠাৎ সে থমকে গেল । হাত ছুড়ছে কিন্তু এগোল না । বার দুয়েক তার মাথাটা জলে ডুবল ! তারপর সে রাগে চিৎকার করে ঘুরে গিয়ে লাথি ছুড়ল।
ততক্ষণে পিছন থেকে একজন ওকে অতিক্রম করে আমটা ধরে
ফেলেছে ।
“ পা টেনে ধরেছিল । ” বিটু ধর বলল ।
লােকটি হেসে চশমাটা খুলে ঝোলায় রাখল । ঘাটের বাইরের দিকে সেখানে কয়েকজন উড়িয়া ব্রাক্ষ্মণদের একজনের কাছে ঝােলাটা রেখে এসে, লােকটি অতি সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল চশমা ছাড়া , মনে হচ্ছে , লােকটি যেন অন্ধ ।
জলের কিনারে কাদার উপর তখন মারামারি হচ্ছে, একজনের সঙ্গে দু - জনের । কাদা ছিটকোচ্ছে । লােকেরা বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে সরে গেল । দু - তিনটি ছেলে ওদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে ।
“ ঠিক হ্যায় , চালা , আরাে জোরে । ”
পা থেকে মাথার চুল কাদায় লেপা কঞ্জির মতাে সরু চেহারাটা তার লম্বা হাত দুটো এলােপাথাড়ি ডাইনে - বাঁয়ে ঘােরাচ্ছে । অন্য দুজন সেই বিপজ্জনক বৃত্তের বাইরে কুঁজো হয়ে তাক খুঁজছে।
“ ফাইট কোনি ফাইট । চালিয়ে যা বক্সিং । ”
দু - জনের একজন পিছন থেকে ঝাপিয়ে পড়ল ওর উপর । পড়ে গেল দু - জনেই ।
“ অ্যাই অ্যাই ভাদু , চুল টানবি না কোনির । তাহলে কিন্তু আমরা আর চুপ করে থাকব না । ”
কোনির পিঠের উপর বসা ভাদু চুল ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে কোনির মাথা ধরে কাদায় মুখটা ঘষে দেবার চেষ্টা করতে লাগল । কোনি পা ছুড়ল ।
কোমরে চাপ দিয়ে ওঠবার চেষ্টা করল। তারপর ঝটকা দিয়ে ভাদুর ডান হাতটা মুখের কাছে টেনে নিয়ে এসে কামড়ে ধরল দুটো আঙুল ।
চিৎকার করে ভাদু লাফিয়ে উঠল । সঙ্গে সঙ্গে কোনি উঠে দাঁড়িয়ে ভাদুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ।
“ খুবলে নেব তাের চোখ , বার কর আম । আমাকে চোবানাে । পুঁতে রাখব তােকে এই গঙ্গামাটিতে । হয় আম দিবি নয় চোখ নেব । ”
দু - হাতের দশটা আঙুল ইগলের নখের মতাে বেকিয়ে চিত হয়ে পড়া ভাদুর চোখের সামনে কোনি এগিয়ে আনতেই , দুটি ছেলে ওকে ঠেলে সরিয়ে আনল ।
“ ছেড়ে দে চন্ডু , হাত হাড় কান্তি শােধ নিয়ে ছাড়ব। আমাকে চোবানাে ? ”
কোনির ঠোটের কোণে ফেনা , সামনের দাঁত হিংস্রভাবে বেরিয়ে আছে । হিলহিলে লম্বা দেহটা সামনে - পিছনে দুলছে কেউটের ফনার মতাে ।
“ এই ভাদু ও আম কোনির । বার করে দে । নয়তো সত্যিই চোখ তুলে নেবে কিন্তু । "
ভাদু ডান হাতটা চোখের সামনে ধরে দেখছিল । শিউরে উঠে বলল , “ রক্ত বেরােচ্ছে ! দাঁত বসিয়ে গত্তো করে দিয়েছে । ”
কোনির হাত ছেড়ে দিয়ে কান্তি এগিয়ে এসে ভাদুর প্যান্টের পকেটে হাত ঢাকাল । কয়েকটা কঁচা আম বার করে , বাড়ােটি বেছে নিয়ে কোনির দিকে ছুড়ে দিল ।
লুফে নিচেই কোনি কামড় বসাল এবং সঙ্গে সঙ্গে বিকৃত মুখে বলল , 'কী টক রে বাবা । মা গাঙ্গাকে এমন আমও খেতে দেয় ! ”
আমটা জলে জুড়ে দিয়ে সে মুখ থেকে ছিবড়ে ফেলতে ফেলতে ভদুর কাছে এলাে ।
" দেখি তো কেমন গভ্রো হয়েছে । "
খপ করে ভাদুর হাতটা ধরে সে ভ্রু কুঁচকে আঙ্গুলটা তুলে দেখল ।
" ভাগ , কিছু হয়নি । নাম্ নাম জলে নাম । যেমন কাজ করেছিস তেমনি ফল পেয়েছিস ? আমাকে রাগালে কী হয় , এবার বুঝলি তাে ? "
কয়েকটি ডুব দিয়ে লােকটি কোমর জলে দাঁড়িয়ে গামছা ঘষছিল পিঠে । কানে এল পাশের এক বৃদ্ধের আপনমনের গজগজানি ।
“ জালিয়ে মারে হতভাগারা । গঙ্গার ঘাটটাকে নােংরা করে রেখেছে হাঘরে হাভাতের দল । মা গঙ্গাকে উচ্ছুগ্গো করা । আমই রাস্তায় বসে বেচবে। জুটেছে আবার এক মেয়েমদ্দানি বাপ - মাও কিছু বলে না । ”
লােকটি আবার ডুব দিতে যাচ্ছিল , থেমে গিয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকাল ।
"মেয়েমদ্দানিটি কে ! "
" কে আবার দেখতে পাননি , চোখ তাে একজোড়া রয়েছে ।
লােকটি মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল । চশমাছাড়া ঝাপসাভাবে দেখল , ভাদুর হাত ধরে কোনি টানাটানি করছে । কাদামাখা কোনির মধ্য দিয়ে এক একবার একটি মেয়ে ফুটে ফুটে উঠছে যেন । ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা কাদামাখা চুল মাথায় বসে। প্যান্টে গোঁজা গেঞ্জি শরীরের সঙ্গে লেপটে দ্বিতীয় পরত চামড়া হয়ে আছে । দীর্ঘ সরু দেহ । সরু পা , সরু হাত । লােকটি ঠাওর করতে পারছে , কোনি ছেলে কী মেয়ে ।
দুটো ঢেউ পর পর লােকটিকে ধাক্কা দিল । বিষ্টু ধর জলে নেমেছে ।
" অচ্ছা শরীরটাকে চাকর বানানাে , সেটা কী ব্যাপার ? ”
“ সােজা ব্যাপার । লােহা চিওয়ে খেয়ে হুকুম করবেন হজম করে , পাকস্থলী হজম করবে । বলবেন পাঁচ মাইল হাঁটিয়ে নিয়ে চলাে , পা জোড়া অমনি পৌছিয়ে দেবে । সখ হলাে গাছের ডাল ধরে ঝুলবেন , হাত দুটো আপনাকে ঝুলিয়ে রেখে দেবে। এইসব আর কী । "
লােকটি জল থেকে উঠে আলতোভাবে মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে সিঁড়িতে দাঁড়াল । ভিজে গামছাটা নিংড়ে পায়ে লাগা মাটি ধুয়ে গঙ্গার দিকে তাকাল । ঝাপসাভাবে দেখল , পাড়ের কাছে জলে কিলবিল করছে মানুষ । তার মধ্যে কোনিকে চিনে নেওয়া সম্ভব হলো না ।
ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক |
লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে , ঝােলা কাঁধে চশমা মুছতে মুছতে লােকটি একবার সিড়ির মাথায় এসে দাঁড়াল , চশমা চোখে দিয়ে পাড়ের ডাইনে - বাঁয়ে তাকাল , হঠাৎ নজরে এল গঙ্গার বুকে চারটি কালাে ফুটকি । তারা সিকি গঙ্গা পার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ।
লােকটি আপনমনে একবার বলল : “ কোনি । কো ও ও নি । ”
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভিজে গামছাটি পাগড়ির মতাে মাথায় জড়িয়ে লােকটি বাড়ির পথে রওনা হলাে ।
মিনিট পনেরাে পর সরু গলির মধ্যে একতলা টালির চালের একটি বাড়িতে লােকটি ঢুকল । সদর দরজার পরই মাটির উঠোন । টেনেটুনে একটি ভলিবল কোর্ট তাতে হয়ে যায় । লঙ্কা পেঁপে, জবা থেকে চালকুমড়াে পর্যন্ত , উঠোনটা নানান গাছে দখল হয়ে আছে । একদিকে টিনের চালের রান্নাঘর ও কলঘর আর একদিকে দালান ও তার পিছনে দুটি ঘর । একতলা বাড়িটি চারদিকের উঁচু বাড়িগুলাের মধ্যে খুব শান্তভাবে যেন উবু হয়ে বসে । উত্তর দিকে বাড়ির মালিক হলধর বর্ধন এই একতলা বাড়িটি কেনার জন্য বার দুয়েক প্রস্তাব করেছে , কিন্তু লােকটি সংসারে যার স্ত্রী এবং দুটি বিড়াল ছাড়া আর কেউ নেই , বিনীতভাবেই তা প্রত্যাখ্যান করে ।
বাড়ির কলে জল আসে সামান্য । লােকটির স্ত্রীর নাম লীলাবতী । জল খরচ করাটা লীলাবতীর সখ, বিড়াল পােষার মতােই । ফলে লােকটিকে স্নান করার জন্য প্রায়ই রাস্তার টিউবওয়েলটির সাহায্য নিতে হয় । আজ সকাল থেকে টিউবওয়েলের মুখ দিয়ে জল বেরােচ্ছে না । তাই বহুকাল পর সে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিল ।
লােকটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে উঠোনে টাঙানাে তারে ভিজে প্যান্টটা মেলেছে , তখন ঘর থেকে বেরিয়ে এল ঢলঢলে প্যান্ট পরা বেঁটে , হৃষ্টপুষ্ট একজন ।
“ ক্ষিন্দা , তােমার জন্য অনেকক্ষণ বসে আছি , আর বাড়ি পাহারা দিচ্ছি । দোকান থেকে কে বউদিকে ডাকতে এসেছিল , ‘ আসছি ’ বলে সেই যে গেছে । ”
“ ভেলাে , চটপট একটু চা বানা দেখি । ”
“ বউদি যদি এসে পড়ে ! ”
ক্ষিদ্দা অর্থাৎ ক্ষিতীশ সিংহ কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল , “ তাহলে থাক , বরং তুই কী জন্যে এসেছিস বল ? ”
“ ক্লাবের আজকের মিটিংয়ে যাবে নাকি ? ”
নিশ্চয় যাব ছেলেরা খাটবে না , ডিসিপ্লিন মানবে না , জলে নেমে শুধু ইয়ার্কি ফাজলামাে করবে । এসব ছেলেদের ক্লাব থেকে বেরিয়ে যেতে বলাটা কি এমন দোষের ! একজনও কি তাই নিয়ে কিছু ভাবে ? আর ক্ষিতীশ সিঙ্গি অমনি তই নিয়ে কাউন্সিলের মিটিং ডাকা হলাে । ”
“ সেজন্য তো নয় , আসলে হরিচরণ আর তার গ্রুপটির রাগ আছে তোমার ওপর । ওরাই শ্যামল আর গোবিন্দকে উসকে তোমার এগেনস্টে চার্জ আনিয়েছে । ”
“ আমি তা জানি । হরিচরণের বহুদিনের ইচ্ছে চিফ ট্রেনার হওয়ার । আমাকে বলেছিল গত বছর। আমি বলেছিলুম , হরি , একটা চ্যাম্পিয়ন শুধু খাওয়া - দাওয়া আর ট্রেনিং দিয়েই তৈরি করা হয় না রে । তার মন - মেজাজ বুঝে তাকে চালাতে হয় । ট্রেনারকে মনস্তাত্ত্বিক হতে হবে , তার মানে কমনসেন্স প্রয়ােগ করতে হবে । গুরুকে শ্রদ্ধেয় হতে হবে শিষ্যের কাছে । কথা , কাজ , উদাহরণ দিয়ে মনের মধ্যে আকাক্ষা বাসনা জাগিয়ে তুলতে হবে । তাকে মােটিভেট করতে হবে । এসব তাের দ্বারা সম্ভব নয় । তুই শুধু চেচামেচি গালাগালি করেই খাটাতে চাস , চিফ্ ট্রেনার হওয়া তোর কম্মো নয় ।”
“ ক্ষিদ্দা , তোমার এই লেকচার দেবার বদ অভ্যেসটা ছাড়াে । এককথায় যেখানে কাজ হয় , তুমি সেখানে দশ কথা বলাে । হরিচরণদাকে অত কথা বলার কী দরকার ছিল । যাকগে , আজ তুমি মিটিংয়ে যেও না , ওরা ঠিক করছে তােমাকে অপমান করবে । ”
“ করে করবে । ” এই বলে ক্ষিতীশ তার পায়ে মাথা ঘষায় বস্তু বিশুকে কোলে তুলে গলা চুলকে দিতে লাগল । চোখ বুজে বিশু ঘরর ঘরর শুরু করল ।
“ তাহলে যাবেই ! ” নেমে যাওয়া প্যান্ট এবং কণ্ঠস্বর হ্যাচকা দিয়ে টেনে তুলে ভেলাে বলল ।
ক্ষতীশ ঘরের দিকে যেতে যেতে অস্ফুটে বলল , “হুঁ। ”
তখনই বাড়িতে ঢুকল লীলাবতী সিংহ । অতি ছোটখাট , গেীরবর্ণা এবং গম্ভীর । পায়ে চটি , হাতে ছাতা । দু - জনের দিকে তাকিয়ে অবশেষে ভেলােকে বলল , “ বেলা অনেক হয়েছে , চাট্টি ভাত খেয়ে যেও । ”
ভেলাের হঠাৎ যেন কাণ্ডজ্ঞান ফিরে এল । ঘড়ি দেখেই ব্যস্ত হয়ে বলল , “ না না বউদি , ইসস বড় দেরি হয়ে গেল , বাড়িতে ভাত নিয়ে বসে আছে । আমি এখন যাই । ক্ষিদ্দা , তোমার কিন্তু না গেলেই ভালাে । ”
ভেলাে চলে যেতেই লীলাবতী প্রশ্ন করল ক্ষিতীশকে “ না গেলেই ভালাে মানে ? ”
“ আজ ক্লাবের একটা মিটিং আছে । ও বলছে সেখানে আমাকে নাকি কেউ কেউ অপমান করবে যাতে ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে যাই । ”
“ তাহলে তাে ভালোই হয় । ক্লাব - ক্লাব করে তাে কোনােদিন ব্যবসা দেখলে না । আমি মেয়েমানুষ , আমাকেই কিনা দোকান দেখতে হয় । নেহাত ছেলেপুলে নেই তাই যদি ক্লাব তােমায় তাড়ায় তাহলে আমি বেঁচে যাই । ”
লীলাবতী রান্নাঘরে ঢুকল । ক্ষিতীশ বিষন্ন চোখে দালানে বসে বিশুর মাথায় আনমনে হাত বােলাতে লাগল । এই সময় খুশি ঘর থেকে বেরিয়ে এল । ডন দিয়ে , হাই তুলে ধীরে ধীরে সে চামরের মতাে কালাে লেজটি উঁচিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল ক্ষিতীশের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে ।
“ কই এসাে । ” রান্নাঘর থেকে ডাক এল ।
ক্ষিতীশ অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখে গিয়ে ভাত খেতে বসল ।
খাওয়ার আয়ােজন সামান্য । রান্না হয় কুকারে । প্রায় সবই সিদ্ধ । এটা খরচ , সময় ও শ্রম সংক্ষেপের জন্য নয় । ক্ষিতীশ বিশ্বাস করে , বাঙালিয়ানা রান্নায় স্বাস্থ্য রাখা চলে না । এতে পেটের বারােটা বাজিয়ে দেয় । সেইজন্যই বাঙালিরা শরীরে তাগদ পায় না , কোনাে খেলাতেই বেশি উঁচুতে উঠতে পারে না । খাদ্যপ্রাণ যথাসম্ভব অটুট থাকে সিদ্ধ করে খেলে এবং সর্বাধিক প্রােটিন ও ভিটামিন পাওয়া যায় এমন খাদ্যই খাওয়া উচিত ।
প্রথম দিকে লীলাবতী বিদ্রোহী হয়েছিল , সরষেবাটা , শুকনাে লঙ্কাবাটা , পাঁচফোড়ন , জিরে , ধনে প্রভৃতি বস্তুগুলি রান্নায় ব্যবহারের সুযােগ হারিয়ে । ' তুমুল ঝগড়া এবং তিনদিন অনশন সত্যাগ্রহেও কাজ হয়নি । ক্ষিতীশ তার সিদ্ধান্তে গোঁয়ারের মতাে অটল থাকে । তার এক কথা : শরীরের নাম মহাশয় যা সহাবে তাই সয় । অবশেষে লীলাবতী সপ্তাহে একদিন সরষে ও লঙ্কাবাটা ব্যবহারের অনুমতি পায় , শুধুমাত্র নিজের খাবারের জন্য । ক্ষিতীশ কখনাে যজ্ঞিবাড়ির নিমন্ত্রণে যায় না । ক্লাবের ছেলেমেয়েদের সে প্রায়ই শােনায় , ডাক্তার রায় বলতেন , বিয়ে বাড়ির এক একটা নেমন্তন্ন খাওয়া মানে এক এক বছরের আয়ু কমে যাওয়া । বড়ো খাঁটি কথা বলে গেছেন ।
ক্ষিতীশ কথা না বলে খাওয়া শেষ করল ।
ও যে রাগ করেছে লীলাবতী বুঝতে পেরেছে । বলল , “ ক্লাব থেকে তাড়াবে কেন ? কী দোষ করলে ? ”
ক্ষিতীশ পালটা প্রশ্ন করল , “ তুমি এখন আবার দোকানে গেছলে কেন ? ”
গে স্ট্রিটে ট্রামলাইন ঘেষে একফালি ঘরে দোকানটি । নাম ' প্রজাপতি ' । আগে নাম ছিল ' সিনহা টেলারিং ' । দুটি দর্জিতে জামা - প্যান্ট তৈরি করত , আর দেয়াল আলমারিতে ছিল কিছু সিন্থেটিক কাপড় । ক্ষিতীশ তখন দোকান চালাত । দিনে দু - ঘণ্টাও দােকানে বসত না । দুপুর বাদে তাকে সর্বদাই পাওয়া যেত জুপিটার সুইমিং ক্লাবে। তারপর একদিন সে আবিষ্কার করল আলমারির কাপড় অর্ধেকেরও বেশি অদৃশ্য হয়েছে , দােকানের ভাড়া চার মাস বাকি এবং লাভের বদলে লােকসান শুরু হয়েছে ।
তথনই লীলাবতী হস্তক্ষেপ করে , দোকানের দায়িত্ব নেয় । টেলারিং ডিপ্লোমা পাওয়া দুটি মহিলাকে নিয়ে সে দোকানটিকে ঢেলে সাজায় নিজের গহনা বাধা দিয়ে । নাম দেয় ' প্রজাপতি । পুরুষদের পােশাক তৈরি বন্ধ করে দিয়ে শুধুমাত্র মেয়েদের এবং বাচ্চালের পােশাক তৈরি করে । দোকানে পুরুষ কর্মচারী নেই এবং চার বছরের মধ্যেই প্রজাপতি ডানা মেলে দিয়েছে । আগে তিনদিনে ব্লাউজ তৈরি করে দেওয়া হতাে , এখন দশদিনের আগে সম্ভব হচ্ছে না । লীলাবতী তার গহনাগুলির অর্ধেকই ফিরিয়ে এনেছে ।
“ এখন তাে আর জায়গায় কুলােয় না , তাই বড়াে ঘর খুজছি । হাতিবাগানের মােড়ে একটা খোঁজ পাওয়া গেছে । আমাদেরই এক খদ্দেরের বাড়ি । বাড়ির গিন্নি এসেছিল মেয়ের ফ্রক করাতে । তাই গেছলুম কথা বলতে । ” লীলাবতী এঁটো থালাটা টেনে নিয়ে তাতে ভাত বেড়ে ডাল মাখতে মাখতে বলল ।
ক্ষিতীশের প্রবল আপত্তি ছিল তার খাওয়া থালায় লীলাবতীর খাওয়ায় । “ আনহাইঞ্জিনিক । এইসব কুসংস্কারেই বাঙালি জাতটা গােল্লায় গেল । এই বলে ক্ষিতিশ তর্ক শুরু করেছিল । কিন্তু লীলাবতী যখন অতিরিক্ত ঠান্ডা স্বরে বলল , “ এটা আমার ব্যাপার , মাথা ঘামিও না । ' তখন মুহূর্তে বুঝে যায় আর কথা বাড়ালে তাকেই গােল্লয় যেতে হবে । তবে ক্ষিতীশ তার প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে । লীলাবতীর খাওয়ার সময় তাই কখনােই সে সামনে থাকে না ।
শােবার ঘরের দেয়ালে ক্ষিতিশের বাবা - মা , ধ্যানমগ্ন মহাদেব , কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের সারথি শ্রীকৃষ্ণ এবং ম্যাগাজিন থেকে কেটে বাধানাে মেডেল গলায় ডন শােলান্ডার ও ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দু- হাত তুলে দাঁড়ানাে ডন ফ্রেজারের ছবি , পাশাপাশি টাঙানাে । এছাড়া আছে – সাধারণত যা থাকে – খাট , আলমারি , বাক্স , আলনা এবং টুকিটাকি সাংসারিক জিনিস । পাশের ঘরে বই , ম্যাগাজিন , একটা তক্তপােশ এবং তার নীচে ট্রেনিংয়ের জন্য রবারের দড়ি , স্পিং , লােহা ছাড়া আর কিছু নেই । এই ঘরে ক্ষিতীশ দুপুরে এক ঘণ্টা ঘুমােয় । পাখা নেই , বিছানা নেই । ওর মতে , চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে শিষ্যকেই নয় , গুরুকেও কঠোর জীবনযাপন করতে হবে । অবশ্য তার কোনাে শিষ্য নেই ।
তক্তপােশে শুয়ে চোখ বুজে ক্ষিতীশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল । শিষ্য কোথায় ।
ঘুম আসার ঠিক আগের মুহূর্তে , ক্ষিতীশের আবছায়া চেতনায় ফুটে উঠল লম্বা দুটো হাত বৈঠার মতাে গঙ্গার জ্বলে উঠছে আর পড়ছে ।
মিলিয়ে গিয়ে নতুন আর একটি ছবি সে দেখল । ফণা তােলা কেউটের মতাে হিলহিলে কাদায় লেপা সরু একটা দেহ । লম্বা হাত এলােপাথাড়ি ডাইনে - বাঁয়ে ঘােরাচ্ছে । “ ফইট কোনি , ফাইট ।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে ক্ষিতীশ অকারণেই অস্ফুটে উচ্চারণ করল , “ কো ও ও নি । ”
সম্ভবত নামটা তার ভালাে লেগেছে ।