কোনি(koni) মতি নন্দী রচিত -কোনি উপন্যাস download pdf(পর্ব-৩)

কোনি মতি নন্দী রচিত । দশম শ্রেণির বাংলা উপন্যাস। class x bangali Sahitya-Sonchayan ।। সাহিত্য সঞ্চয়ন দশম শ্রেণী উৎস সন্ধানে। koni download pdf by wb

 

ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক 

লেখক:- মতি নন্দী 

লেখকের পরিচিত :- মতি নন্দী (১০ জুলাই ১৯৩১ - ৩ জানুয়ারি ২০১০) ছিলেন ভারতের কলকাতার একজন বাঙালি লেখক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মতি নন্দী ছিলেন মূলত ক্রীড়া সাংবাদিক এবং উপন্যাসিক ও শিশু সাহিত্যিক। তিনি আনন্দ পুরস্কার এবং সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছেন। তার বিখ্যাত উপন্যাস 'কোনি'। লেখকের সম্বন্ধে আরো পড়ুন  । 


টেবল টেনিস বাের্ডটায় কাপড় বিছিয়ে টেবল । সেটা ঘিরে সাতজন বসে । তার মধ্যে একটি চেয়ার খালি । ওরা চাপা স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে । ঘরের বাইরে কয়েকটি ছেলে , কার যেন প্রতীক্ষায় ।

 

জুপিটার সুইমিং ক্লাবের নতুন প্রেসিডেন্ট এবং এম এল এ বিনােদ ভাড় , ডানদিকে ঝুঁকে সম্পাদক ধীরেন ঘােষাকে বলল , “ একটাই অ্যাজেন্ডা , না আরাে আছে ? 


ধীরেন ঘােষ তার সরু গলাটি যথাসম্ভব লম্বা করে চশমার নীচের অংশের প্লাস পাওয়ারের মধ্য দিয়ে টেবলে রাখা কাগজের দিকে তাকাল । 


“ মেন আইটেম একটাই , আর যা আছে তা খুবই      মাইনর । ” 


“ কোরাম হয়েছে তাে ? ” 


“ হ্যা , সবাই হাজির । ” ধীরেন ঘােষ এরপর ব্যস্ত হয়ে বলল , “ জগু , চা - সন্দেশ দিতে বল । ”


যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে মাত্র , তখনই দরজাটা খুলে গেল । ক্ষিতীশ সিংহ ঘরের প্রতিটি লােকের মুখে উপর চোখ বুলিয়ে , প্রেসিডেন্টের মুখােমুখি খালি চেয়ারটায় বসার আগে সভাকে নমস্কার জানাল । 


জগু জিজ্ঞাসু চোখে ধীরেন ঘােষের দিকে তাকাল, মাথা হেলিয়ে ধীরেন ঘােষ বলল , “ একটু পরে আনবি । ” 


“ আমার দেরি হয়ে গেল । ” ক্ষিতীশ ফিকে হেসে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকা

ল । 


“ না না , মিনিট চারেক মাত্র দেরি হয়েছে । ” বিনােদ ভড় ঘড়ি দেখে ধীরেন ঘােষাকে বলল , “ আমার কিন্তু একটু তাড়া আছে । ” 


“ নিশ্চয় নিশ্চয় , এখুনি শুরু করছি । বেশিক্ষণ লাগার মতাে কিছুই নেই , শুধু সুইমারদের চিঠিটা ছাড়া । আর সেটা আগেই সারকুলেট করা হয়েছে, সুতরাং নতুন করে বলার কিছু নেই । ” 


“ হ্যা আছে । ”


সবাই ক্ষিতীশের দিকে তাকাল । 


“ আমার বিরুদ্ধে চার্জগুলাে স্পষ্ট করে চিঠিতে বলা নেই । সেগুলাে জানতে চাই । ” 


সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল । 


বিনােদ ভড় বলল , “ ধীরেনবাবু , ওর বিরুদ্ধে যা যা অভিযােগ উঠেছে সেগুলাে তাহলে বলুন । ”


ধীরেন ঘােষ বিব্রতভাবে হরিচরণ মিত্তিরের দিকে তাকাল , হরিচরণ নড়ে - চড়ে বসল । 


“ ক্ষিদ্দা সম্পর্কে অভিযোেগ ছেলেদের মানে সুইমারদের । যারা সাত বছর , আট বছর আমাদের ক্লাবের হয়ে বিভিন্ন কম্পিটিশনে নামছে, মেডেল আনছে । মানে , আমাদের মুখােজ্জ্বল করছে । ” 


“ বাজে কথা । ” ক্ষিতীশ গম্ভীর স্বরে বলল , “মেডেল হয়তাে আনে কিন্তু মুখােজ্জ্বল করার মতাে কিছুই করেনি । শ্যামল চার বছর আগে এক মিনিট চার সেকেন্ডে হানড্রেড মিটার ফ্রি স্টাইল টানতাে , এখনাে তাই টানে । এটা কি মুখােজ্জ্বল করার মতাে ব্যাপার ? ”


হরিচরণ কথাগুলাে না শােনার ভান করে বলতে লাগল , “ এইসব সুইমাররাই হচ্ছে ক্লাবের প্রাণ । এদের নিয়েই ক্লাব টিকে আছে , এগিয়ে চলেছে । এরা উজ্জ্বল , এরা চঞ্চল । এদের হ্যান্ডেল করতে হলে এদের মতাে হয়ে এদের সঙ্গে মিশতে হবে , বুঝতে হবে , আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে হবে । ” 


“ তার মানে রাস্তার মােড়ে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারবে , পড়াশুনা করবে না , ট্রেনিং করবে না একে উচ্ছলতা বলে মানতে হবে ! এদের সঙ্গে তাল রেখে আমাকে আধুনিক হতে হবে , তবেই এদের হ্যান্ডেল করা যাবে ? ” 


“ কিন্তু ওদের মন - মেজাজ বােঝার ক্ষমতা , দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে , ক্ষিদ্দার নেই । ”


হরিচরণ সকলের মুখের দিকে তাকাল । তিন - চারটি মাথা নড়ে উঠল একসঙ্গে সমর্থন জানিয়ে । ক্ষিতীশের চোখ পিটপিট করতে লাগল , পুরু লেন্সের ওধারে । 


“ ক্ষিদ্দা জুনিয়ার ছেলেদের সামনেই শ্যামলকে তার টাইম আর আমেরিকার ১২ বছরের মেয়েদের টাইমের তুলনা করে অপমান করেছেন ; গােবিন্দ এখনাে ব্রেস্ট স্ট্রোকে বেঙ্গল রেকর্ড হােল্ড করছে , লাস্ট ইয়ারেও বােমবাই ন্যাশনালে গেছল , তাকে বলেছেন কান ধরে ক্লাব থেকে বার করে দেবে । সুহাস ইনফ্লুয়েঞ্জায় পড়ে দিন দশেক আসতে পারেনি । তার বাড়িতে গিয়ে ক্ষিদ্দা সুহাসের বাবাকে যা তা কথা বলে এসেছেন । অমিয়া আর বেলা জুপিটার ছেড়ে অ্যাপোলােয় গেছে শুধুই ক্ষিদ্দার জন্য । উনি ওদের চুল কাটতে চেয়েছিলেন । পুরুষদের মতাে ওদেরও বারবেল নিয়ে একসারসাইজ করার জন্য ঝগড়া করতেন । ওদের ড্রেস , ওদের সাজ নিয়ে রােজই খিটখিট করতেন । লাস্ট ইয়ারে আপনারা দেখেছেন , ওই দুটি মেয়ের জন্যই স্টেট মিটে অ্যাপােলাে টিম চ্যাম্পিয়নশিপ পায় । ”

ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক 

হরিচরণ থামল । ক্ষিতীশের দিকে এতক্ষণ সে তাকায়নি । দখল মুচকি মুচকি হাসছে । তাইতে সে অস্বস্তি বােধ করে বীরেন ঘােষ , প্রফুল্ল বসাক এবং বনু চাটুজ্জের মুখের দিকে তাকাল । 


নস্যির কৌটো বার করার জন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে , গলা খাঁকারি দিয়ে বদু চাটুজ্জে সিধে হয়ে বসল । 


“ প্রেসিডেন্ট স্যার , আমার একটা কথা বলার আছে । ট্রেনার যে হবে তার উপর ছেলেদের বা মেয়েদের শ্রদ্ধা থাকা চাই , আস্থা থাকা চাই । সে যেটা বলবে ওরা যেন নিশ্চিন্তে চোখ বুজে সেটা করতে পারে । কিন্তু ক্ষিতীশ ওদের যা বলে সেটা ওরা বিশ্বাসভরে নিতে পারে কি ? " 


বদু চাটুজ্জে নাটকীয়তা সৃষ্টির জন্য কথা থামিয়ে রুমাল বার করল । নাক মুছল গভীর মনােযােগে । রুমাল পকেটে রাখল । 


“ ক্ষিতীশ নিজে কখনাে সাঁতার কাটেনি । কম্পিটিশনে কখনাে নেমেছে বলে জানি না । ওর কথা ছেলেমেয়েরা কেন গ্রাহ্য করবে ” 


“ সে কী ! প্রেসিডেন্ট বিনোদ ভড় অবাক হয়ে ক্ষিতীশের দিকে তাকাল । আপনি সাঁতার জানেন না ? ” 


ক্ষিতীশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল , “ সাতার জানি না বলতে বদু নিশ্চয় মিন করছে , আমি কখনাে কোনাে কম্পিটিশনে মেডেল পাইনি । তাই না ? 


হ্যাঁ হ্যাঁ , আমি তাই - ই বলছি । ” বাস্তু হয়ে বদু বলল । “ কোচের রেপুটেশন থাকা দরকার । নয়তাে ছেলেমেয়েরা মানবে লে ? হরিচরণকে ওরা মানে কেন ? ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ন ছিল , অলিম্পিকে গেছে । গঙ্গায় ১৩ মাইলের কম্পিটিশন পর পর তিনবার জিতেছে । ” 


“ আপনি ওলিম্পিকে গেছলেন ! ” বিনােদ ভাড়ের বিস্মিত ভ্রু কপাল বেয়ে চুলে গিয়ে ঠেকল ।


 কিঞ্চিৎ গদ্গদ স্বরে হরিচরণ বলল , “ লন্ডনে ফরটি এইট ওলিম্পিকে আমি দেড় হাজার মিটারে ইন্ডিয়াকে রিপ্রেজেন্ট করেছি । ওয়াটারপােলাে টিমেও ছিলুম । ” 


“ কী রেজাল্ট করেছিলেন ? ” প্রেসিডেন্ট ঝুঁকে পড়ল টেবিলে । 


হরিচরণ দ্রুত সকলের মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে ঢোক গিলে বলল , " পয়েন্ট ফাইন্ড সেকেণ্ডের জন্য ব্রোঞ্জটা মিস করেছি । ”


 হঠাৎ বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করল ক্ষিতীশ । সবাই তার দিকে তাকাল । 


কাশি থামিয়ে ক্ষিতীশ বলল , “ আই অ্যাম সরি । মাঝে মাঝে আমার এরকম হয় । ” 


প্রেসিডেন্ট বিরক্ত চোখ দুটো সরিয়ে নিয়ে আবার রাখল হরিচরণের মুখে । 


“ গােল্ড পেয়েছিল আমেরিকার ম্যাকলেন । জল থেকে উঠে আমায় বলেছিল , তুমি পাশে ছিলে তাই এত ভালাে চার্জ পেয়েছি । ” 


“ বট লটে , তা আপনি কী বললেন ? ”   


“ আমি আর কী বলব , ওকে কনগ্রাচুলেটি করে বললুম , ইন্ডিয়াতে যে টাইম করে এসেছি সেটা যদি আজ করতে পারতুম তাহলে ... ”


হরিচরণ থেমে গেল । 


খুক খুক একটা শব্দ হচ্ছে । প্রেসিডেন্ট বিরক্ত হয়ে বলল , “ আবার আপনি কাশছেন ? নিশ্চয় আপনার কাশির অসুখ আছে । ” 


ক্ষিতীশ মুখ নীচু করে ফিসফিসিয়ে বলল , " হরি , গােল্ড না সিলভার , তাহলে কোনটে হতো ? ” 


হরিচরণ উত্তেজিত স্বরে বলল , “ মেডেলের কথা তাে আমি বলিনি , তুমি হঠাৎ গায়ে পড়ে টিপুনি কাটছ কেন ? ” 


“ জেলাশি । ”


নস্যির কোটায় চাঁটা নিয়ে বনদু মন্ত্রণ করল । 


“ ক্ষিতীশ বড়াে ফালতু কথা বলে । ” কার্তিক সাহা এতক্ষণে মুখ খুলল । “ বারবার দেখেছি কখনই ও হরিকে সহ্য করতে পারি না । ” 


“ জেলাসিই হােক ফেলাসিই হােক , আমাকে পাঁচজনের সামনে বিদ্রুপ করে তুমি কী আনন্দ পাও ক্ষিদ্দা বলাে    তাে ? ” 


ক্ষিতীশ চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে টেবিলে রাখল । কঠিন স্বরে বলল , “ আমার বিরুদ্ধে আর কী অভিযােগ আহে ধীরেন ? " 


ধীরেন ঘােষ তাড়াতাড়ি ঝুঁকে কয়েকটা কাগজ উলটেপালটে বলল , “ এই সবই আর কী । অভিযােগ এনেছে সুইমাররা । ওরা বাইরেই আছে। প্রেসিডেন্ট যদি বলেন তাে ওরা নিজেরাই এখানে এসে বলতে পারে । ” 


" না , তার দরকার নেই । ” ক্ষিতীশ চশমাটা চোখে পরল , “ অভিযােগগুলি সত্যি । ” 


টেবলের মুখগুলি উজ্জ্বল হয়ে উঠল । কেউ মাথা নাড়ল , কেউ নড়েচড়ে বসল । ওদের ভাবভঙ্গিতে এই কথাটাই ফুটে উঠল - এইবার , তাহলে বাছাধন এইবার কী বলবে ? 



“ আমি জানি ওরা কি বলবে । বলবে , আমি জলে নামি না , খাঁটিতে বলি , না খাটলে গালাগালি করি। আপনারা বলবেন , আমি রেজাল্ট দেখাতে পারিনি তিন - চার বছর , আমার ব্যবহারে সুইমাররা বিদ্রোহ করেছে । ” 


এমনকি মরবেও বলেছে । ” যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য কথাটা বলেই , ধীরেন ও হরিচরণের ভ্রুকুটি দেখে থতমত হয়ে , “ কী কাণ্ড , এথনাে চা দিয়ে গেল না। ” বলতে বলতে উঠে বেরিয়ে গেল । 


“ অভিযােগের জবাব নিশ্চয় আমাকে দিতে হবে।”


প্রেসিডেন্ট গম্ভীর হয়ে বলল , “ সেটা আপনার ইচ্ছে । কিছু বলার থাকলে নিশ্চয় আমরা শুনব ।


সার ঘর উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে । চশমাটা আবার টেবলে রেখে ক্ষিতীশ চোখ বোজে । 


“ এই ক্লাবে আমি প্রথম আসি পয়ত্রিশ বছর আগে। ধরেনও তখন আসে । বছর পাঁচেক পর হরিচরণ । ওদের মতাে জুপিটারকে আমিও ভালােবাসি । আমিও চাই জুপিটারের গৌরব , চাই ভারতের সেরা হয়ে উঠুক জুপিটার । এই গৌরব এনে দেয় সাঁতারুরা , ওয়াটারপােলো প্লেয়াররা , ডাইভাররা । ওদের পারফরমেন্স যত উঠবে , গেীরবও তত বাড়বে । আমার যা কিছু চেষ্টা , তা ওদের উন্নতির জন্যই । এজন্য আমি কঠোর হয়েছি , গালিগালাজও দিয়েছি । ” 


ক্ষিতীশের বলার ভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরে ঘরটা গম্ভীর থমথমে হয়ে উঠল । 


“ সাতারে অবিশ্বাস্য রকমে পৃথিবী এগিয়ে গেছে । আর আমরা ? আমাদের এক একটা রেকর্ডের বয়স দশ পনেরাে বছর । পঁচিশ বছর হতে চলল শচিন নাগের রেকর্ডের বয়স ! কেন এই থমকে থাকা ? যেভাবে পৃথিবী এগােচ্ছে , আমাদেরও সেইভাবে এগােতে হবে । ” 


“ এসব এমন কিছু কথা নয় ; আমাদের জানা আছে । শুনতে ভালােই লাগে । ” হরিচরণ ভারিক্কি চালে বলল এবং প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাল । " আসল যে জিনিস ফুড সেটা কই ? খাটবে যে খাদ্য কই ? তা যখন পাওয়া যাবে না তখন খাটিয়ে খাটিয়ে টি বি রােগ ধরিয়ে দিয়ে লাভ কিছু হবে ?” 


“ ঠিক কথা । ফুড কই ? ” 


যজ্ঞেশ্বর টেবল চাপড়ে বলে উঠল । 


প্রেসিডেন্ট এবং ধীরেন ঘােষ মাথা নাড়ল । 


বদু কৌটো থেকে বড়েী এক টিপ নস্যি বার করল ।


 “ বাজে কথা । ” 


ক্ষিতীশ চাপা এবং দৃঢ়স্বরে বলল ।


“ আজ পর্যন্ত কেউ টিবি রুগি হয়েছে সাঁতার কেটে, এমন কথা শুনিনি । আসলে এটা অলস ফাকিবাজদের , যাদের উচ্চাকাক্ষা নেই তাদের অজুহাত । যতটুকু খাদ্য আমরা জোটাতে পারি , সেই অনুপাতে আমরা ট্রেনিং করি না । শ্যামল , গােবিন্দ বিদ্যেবুদ্ধির জন্য নয় , সাঁতারের জন্যই চাকরি পেয়েছে । কিন্তু সাতারকে তারা এর বিনিময়ে কী দিচ্ছে । এরা অকৃতজ্ঞ । এরা গুছিয়ে রােজ পাঁচ টাকাও যদি খাওয়ার জন্য খরচ করে , ডিসিপ্লিনড লাইফ লিড করে , নিয়মিত কঠিন ট্রেনিং করে , তাহলে দু - বছরেই এরা এক মিনিটে একশাে মিটার ফ্রি স্টাইল কাটবে , এক পাঁচে ব্যাক স্ট্রোক কাটবে । ” 


“ তাহলে এদের ট্রেনিং করাতে পারেননি কেন ? ” ধীরেন বলল । 


“ ছেলে ফেল করলে দোষটা মাস্টারমশায়েরও । ” কার্তিক কনুই দিয়ে বদুকে খোঁচা দিল । 


“ নিশ্চয় , শুধু ওদের অকৃতজ্ঞ বলে নিজের দোষ স্থালন করলে কি চলে ! ” 


“ না , আমি দোষ স্থালন করতে চাই না । বরং আমি বলতে চাই , এদের দিয়ে আর কিছু হবে না । এদের বয়স হয়ে গেছে , এদের মনে পচ ধরেছে । এদের পিছনে পরিশ্রম করে লাভ নেই । ” 


“ আমি বিশ্বাস করি না । ” হরিচরণের তীব্র স্বরে ক্ষিতীশও বিস্মিত হলাে । 


“ কী বিশ্বাস করিস না ? ” 


“ এদের নিয়ে এখনাে টাইম কমানাে যায় । আমি করতে পারি । আমি পারি এদের খাটাতে । পচ টচ ধরেছে এসব বাজে কথা । " 


ক্ষিতীশ কিছুক্ষণ হরিচরণের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল । 


“ তাহলে তুই দায়িত্ব নে । আমি আজ থেকে চিফ ট্রেনারের পদ ছেড়ে দিলাম । রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দেবাে । আমি কাল থেকে আর আসব    না । " 


“ না না , আসবে না এটা কী কথা ! " বধু ব্যস্ত হয়ে উঠল । “ এতদিনকার মেম্বার ! " 


ক্ষিতীশ হাসল ম্লানভাবে , তারপরই চোখ দুটো পিট পিট করে উঠল । প্রেসিডেন্টকে লক্ষ করে বলল , “ ট্রেনার হতে গেলে নামকরা সাঁতারু হতে হবে , এমন কোনাে কথা নেই । পৃথিবীর নামকরা কোচেরা - ট্যালবট , কারলাইল , গ্যালাঘার , হেইন্স , কাউন্সিলম্যান এরা কেউ ওলিম্পিক চামপিয়ন নয় । জলে নেমে এদের কোচ করতে হয় না । এরা সুইমারদের কোচ , নভিসদের নয় । জালের উপর থেকেই অনেক ভালাে লক্ষ করা যায় , তাই ডাঙ্গতেই আমি থাকি । ” 


" ক্ষিদ্দা , তুমি দেখছি ওইসব কোচদের সঙ্গে নিজেকে এক পঙক্তিতে ফেললে । ” যজ্ঞেশ্বর কৃত্রিম বিস্ময় চোখে ফোটাল । 


“ ওরা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন , অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন তৈরি করেছে , তুমি তো একটা বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন  তৈরি করতে পারনি ! " কার্তিক সাহার গলায় বিদ্রুপ মােচড় দিল । 


“ পারবে পারবে , নিশ্চয় পারবে । ওয়ার্ল্ড রেকর্ড আমরা শিগ্গিরই পাব , তাই না ক্ষিতীশ ? ” ধীরেন ঘােষ মুচকি মুচকি হাসতে লাগল । 


“ চ্যাম্পিয়ন সুইমার তৈরি করা এদেশে সম্ভব নয়।” প্রেসিডেন্ট বিনােদ ভড় এতক্ষণে কথা বলল ।


ক্ষিতীশ উঠে দাঁড়াল । 


“ কোনাে দেশেই সম্ভব নয় । চ্যাম্পিয়নরা জম্মায় , ওদের তৈরি করা যায় না । ওদের খোঁজে থাকতে হয় , লক্ষণ মিলিয়ে চিনে নিতে হয় ।” ক্লান্তস্বরে কথাগুলাে বালে ক্ষিতীশ দরজার দিকে এগােল । 


" সেই ভালাে , এবার থেকে তপস্যা শুরু করো ক্ষিদ্দা  । " 


“ ক্ষিতীশ , চা - টা খেয়ে যাও । ” 


“ ক্ষিীশবাবু , ক্লাবে আপনার কিন্তু রেগুলার আসা চাই । ”


ঘর থেকে বেরিয়ে ক্ষিতীশ দেখল শ্যামল , গােবিন্দ এবং আরাে চার পাঁচটি ছেলে দাঁড়িয়ে । প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকাল । সে । ওরা হঠাৎ কাঠের মতাে হয়ে গেল । 


“ তোদের অনেক বকেছি ঝকেছি , কটু কথাও বলেছি । আর এসব শুনতে হবে না । আজ থেকে আমি আর এ ক্লাবের ট্রেনার নই । সাঁতারটা মন দিয়ে করিস । ” 


ক্ষিতীশ মাথা নামিয়ে ধীর পায়ে ক্লাবের বাইরে এসে   দাঁড়াল । 


কমলদিঘির কালাে জলের উপর পার্কের আলােগুলাে খড়ির মতাে দাগ টেনেছে । জুপিটার ক্লাববাড়ির চুডাের ঘড়িতে আটটা বাজতে পাঁচ । দিঘিটা আকারে গােল । তাকে ঘিরে ইট বাঁধানাে রাস্তা । নারী পুরুষ শিশুর ভিড়ে রাস্তাটা গিজগিজ করছে । আলোগুলাের নীচে তাস খেলা চলছে , অকসন ব্রিজ বা টোয়েন্টিনাইন । মাঝে মাঝে দমকা চিৎকার উঠছে তাসের আড্ডা থেকে । বেঞ্চগুলােয় বসার স্থান নেই । ফুলগাছের ঝােপগুলাে লোহার বেড়ায় ঘেরা । বেড়ায় ঠেস দিয়ে যুবকরা গল্প করছে । ঘুগনি , আলুকাবলি , বাদাম , ঝালমুড়ি বা কুলফি মালাইওয়ালারা ব্যবসায়ে ব্যস্ত ।


দুটি হাত রেলিংয়ে রেখে ক্ষিতীশ দিঘির অন্ধকার জলের দিকে তাকিয়ে । জুপিটারের ঠিক উলটোদিকেই অ্যাপােলাের ক্লাববাড়ি । ডাইভিং বাের্ডের কংক্রিট কাঠামাের থামগুলাে অন্ধকারে ব্রহ্মদত্যির পায়ের মতাে জল থেকে উঠেছে ।


“ ক্ষিদ্দা ! ” 


চমকে পিছনে কনী ক্ষিতীশ । 


“ ভেলাে ? ” 


“ কী হলাে ক্ষিদ্দা ? ” 


“ কী আবার হবে , ছেড়ে দিলুম । ” 


“ ভালোই করেছ । ঝগড়াঝাটি , গােলমাল হয়নি তো ? ” 


“ না । ” 


ক্ষিতীশ মুখটা আবার জলের দিকে ঘােরাল । হাওয়া বয়ে আসছে জলের উপর দিয়ে । বাতাসে জলের কণা , আর শ্যাওলা আর ঝাঝির আঁশটে গন্ধ । পঁয়ত্রিশ বছর এই শুকে আসছে ক্ষিতীশ । তার কাছে এর থেকে সুবাস পৃথিবীতে নেই ।


 ভোলা পাশে এসে দাঁড়াল । 


“ ভেলাে , কী করি এখন বলতাে রে । একেবারেই বেকার হয়ে গেলুম । ” 


“এবার প্রজাপতিকে বরং দেখাশুনা করাে । বউদি একা মেয়েমানুষ , অন্যরাও মেয়ে , পুরুষমানুষ একজন থাকা দরকার । কখন কী মুশকিলে ওরা পড়ে যাবে তার ঠিক   কী ! " 


“ তাের বউনি মানুষটি ছোট্টখাট্ট , কিন্তু আমার থেকে দশগুণ লম্বা কাজের বেলায় । প্রজাপতিতে দারােয়ানি ছাড়া আমায় দিয়ে আর কোনাে কাজ হবে না । ” 


“ তাহলে ? " 


ক্ষিতীশ আবার জলের দিকে তাকিয়ে রইল । 


“ ক্ষিদ্দা , যদি রাগ না করাে তো একটা কথা    বলি । ” 


ক্ষিতীশ মুখ ফেরাল । 


“ তুমি অ্যাপােলােয় চলাে । ” 


“ না , ওরা জুপিটারের শত্রু । কতকগুলাে স্বার্থপর লােভী মুর্খ আমায় দল পাকিয়ে তাড়িয়েছে বলে শত্রুর ঘরে গিয়ে উঠব ? ” 


“ কিন্তু ওখানে তুমি জল পাবে , শেখাবার ছেলেমেয়ে পাবে , কাজে চইছ কাজ পাবে । অপমানের সােধ তােমায় নিতে হবে । শত্রু  - মিত্র বাছবিচার করে কী লাভ ? ”


ক্ষিতীশ বিব্রতমুখে চুপ করে রইল । তার মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে সেটা তাকে এই মুহূর্তে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে দিচ্ছে না । জুপিটারের সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্ক , কিন্তু সাঁতারু তৈরি করা তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য , ব্রত । লক্ষ্যপূরণ করতে হলে নাড়ির বাঁধন ছিড়ে বেরােতেই হবে । কিন্তু তা কি সে পারবে ? ক্ষিতীশ মাথাটা ঝাকাল ।


 “ তাহলে হেদো কিংবা গােলদিঘির কোনাে ক্লাবে চলাে । ” 


“ কোথাও গিয়ে আমি টিকতে পারব না রে । ” ক্ষিতীশ হাঁটতে শুরু করল একটু জোরেই । 


“ চুপচাপ বসে থাকবে ? ” ভেলাে হ্যাচকা দিয়ে প্যান্ট টেনে তুলে ক্ষিতীশের পাশাপাশি থাকার জন্য প্রায় ছুটতে শুরু করল । 


“ আমি এবার সত্যিকারের কাজ করতে চাই । সবাইকে দেখিয়ে দেবাে একবার । চ্যাম্পিয়ন তৈরি করব আমি । গড়ব আমি মনের মতাে করে । একবার , শুধু একবার যদি তেমন কারুর দেখা পাই । ” 


মাথা নীচু করে ক্ষিতীশ হনহনিয়ে কমলদিঘির গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তার ভিড়ে মিশে গেল । ভেলাে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গেটের পাশে দাঁড়ানাে আলুকাবলিওলাকে বলল , “ জাস্তি ঝাল দিয়ে চার আনার বানাও । ”


                         কোনি চতুর্থ পর্ব


                      পিডিএফ ডাউনলোড করুন


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনাদের কোন প্রশ্ন থাকলে দয়া করে জানাবেন ।