![]() |
| ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক |
লেখক-: মতি নন্দী
লেখকের পরিচিত :- মতি নন্দী (১০ জুলাই ১৯৩১ - ৩ জানুয়ারি ২০১০) ছিলেন ভারতের কলকাতার একজন বাঙালি লেখক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মতি নন্দী ছিলেন মূলত ক্রীড়া সাংবাদিক এবং উপন্যাসিক ও শিশু সাহিত্যিক। তিনি আনন্দ পুরস্কার এবং সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছেন। তার বিখ্যাত উপন্যাস 'কোনি'। লেখকের সম্বন্ধে আরো পড়ুন
সকাল আটটা প্রায় ।
ক্ষিতীশ বাজার করে ফিরছে । জুপিটারে আর সে যায় না । সকাল - বিকাল এখন তার কোনাে কাজ নেই । অবশ্য বাজার করাটা তার নিত্যদিনের কাজগুলির অন্যতম । সে বাজারে যায় বাড়ির কাছের বস্তির সরু গলি দিয়ে , ফেরে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুতে চিলড্রেনস পার্কটাকে ঘুরে অন্য পথ ধরে ।
আজ ফেরার পথে দেখল পার্কে খুব ভিড় । বিশ্রাম চালাটায় টেবিল চেয়ার পাতা । লাউডস্পিকারে হিন্দি ফিল্মের গান বাজছে । হঠাৎ বন্ধ করে ঘােষণা হলাে – “ নেতাজি বালক সঙ্ঘরে উদ্যোগে কুড়ি ঘণ্টা অবিরাম ভ্রমণ প্রতিযােগিতা । প্রতিযােগিতা শুরু হয়েছে কাল রাত আটটায় । শেষ হবে আজ বিকেল চারিটায় । ”
লাউডস্পিকারে অন্য একটা চাপা গলা শােনা গেল : “ এই শালা , চারিটায় কি রে , বল্ চার ঘটিকায় । অ্যালাউনস করতে হলে শুদ্ধু করে বলতে হয় । ”
“ যা লেখা আছে তাই তাে পড়ছি । ”
“ দে দে , আমাকে মাইক দে । ”
এরপর অন্য এক কণ্ঠে শােনা গেল : “ পতিযােগিতা শুরু হইয়াছে কল্য রাত্রি আট ঘটিকায় , উদ্বােধন করেন অতীতদিনের খ্যাতকীর্তি ফুটবল খেলােয়াড় শ্রীকৃষ্ণপ্রসাদ মাইতি। প্রতিযােগিতা সমাপ্ত হইবে অদ্য বৈকাল চারি ঘটিকায় । পুরস্কার বিতরণ করিবেন সন্ধেয় জননেতা ও আমাদের সঙ্গের প্রধান পিষ্টপােষক শ্রীবিষ্টুচরণ ধর মহাশয় । পতিযােগিতায় নেমেছিল বাইশজন পতিযােগী , আটজন অবসর নিয়েছে ইতিমধ্যে । ”
ক্ষিতীশের চোখ হঠাৎ , আটিকে গেছে কঞ্চির মতো লম্বা , নিককালাে একটি চেহারাতে ।
গােলাকৃতি পার্কটিকে ঘিরে রেলিং । তার থেকে ছয় হাত ভিতরে সিমেন্টের পথটা বেড় দিয়েছে মধ্যস্থলের ঘাসের জমিকে । প্রতিযােগীরা পথ ধরে হাঁটছে ক্লান্ত , মন্থরগতিতে । অধিকাংশেরই বয়স ১৬-১৭ । বৈশাখের ভয়ংকর রােদ মাথায় নিয়ে , এ সিমেন্টের ওপর ওদের সারা দুপুর হাঁটতে হবে ।
পরনে ঢিলে ফুল প্যান্ট , ঢলঢলে বুশ শার্ট , পায়ে হাওয়াই চটি । চুলটা ছেলেদের মতাে হলেও , ঘাড়ের কিনারে পৌছে গেছে । রাস্তার মাঝ থেকে ক্ষিতীশ রেলিংয়ের ধারে সরে এল ।
ক্ষিতীশের চোখ অনুসরণ করতে লাগল শুধু একজনকেই । পার্কের মধ্যে শিশু ও বালকদেরই ভিড় । বয়স্করা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে শুধুমাত্র ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে চলে যাচ্ছে । প্রতিযােগীদের চোখে রাত্রি জাগরণ , ক্লান্তি আর ক্ষুধার ছাপ । পার্কের চক্কর প্রায় ৭৫ মিটারের । ওদের কেউ কেউ চেনা লােকেদের দেখে শুকানাে হাসছে , দু চারটে কথা বলছে । গঙ্গায় সাঁতারের সঙ্গী । সেই তিনটি ছেলে পার্কের মধ্যে ঘাসের উপর দিয়ে কোনির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ওর সঙ্গে কথা বলল । কোনি হাত নেড়ে ওদের চলে যেতে বলছে। চটিজোড় খুলে পথের পাশে রাখল । উদ্যোক্তাদের দেওয়া লজেঞ্জস্ পকেট থেকে বার করে ওদের তিনজনকে দিয়ে , একটা মুখে পুরল । হাঁটতে হাঁটতে সে মুখের কাছে হাত তুলে জলপানের ইশারা করতেই নেতাজি বালক সঙ্ঘের একজন ছুটে গিয়ে তাকে এক গ্লাস জল দিয়ে এল । তিন - চার চক্করের পর আবার সে চটি পরল ।
ক্ষিতীশের হুঁশ ফিরল যখন তার প্রতিবেশী অমূল্যবাবু অফিস যাবার পথে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “ কী দেখছেন ক্ষিতীশবাবু , বাঙালিদের ক্রীড়াচর্চা ? "
লােকটিকে ক্ষিতীশ একদমই পছন্দ করে না , শুধুই নাটকীয় ঢঙে বাঁকা বাঁকা কথা বলে ।
“ কী আর করবে বলুন , আমরা ওদের স্ক্রীড়াচর্চার জন্যে কিছু ব্যবস্থা তাে করে দিইনি । ওরা ওদের মতােই যা হােক ব্যবস্থা করে নিয়েছে । ”
কথায় কথা বাড়ে । তাই ক্ষিতীশ আর না দাঁড়িয়ে বাড়িমুখাে হলো ।
সদর দরজা তালাবন্ধ । লীলাবতী বেরিয়েছে । অবশ্য দ্বিতীয় চাবি ক্ষিতীশের কাছে আছে । ঘড়ি দেখে সে জিভ কাটল । প্রায় পাঞ্চশ মিনিট দেরি হয়েছে , অর্থাৎ , লীলাবতী এতই রেগেছে যে রান্না না চাপিয়েই বেরিয়ে গেছে ।
ক্ষিতীশ রান্নার উদ্যোগ শুরু করল । আনাজ কুটতে বসে বারবার তার ইচ্ছে করল পার্কে গিয়ে কোনিকে দেখতে । এই দ্বিতীয়বার সে ওকে দেখলে ।
অবিরাম হাটা ব্যাপারটা সে একদমই পছন্দ করে না । এতে বুদ্ধির দরকার হয় না আর বলদের মতাে শুধু পাক খাওয়া । স্পিড় দরকার হয় না , পেশির জোর লাগে না , পমা দিতে হয় না আর একটা মানুষের সঙ্গে । একে স্পাের্ট বলতে ক্ষিতীশের ভীষণ আপত্তি ।
একবার সে গােলদিঘিতে চিৎকার করে তার আপত্তিটা জানিয়েছিল ৯০ ঘণ্টা সাঁতার কেটে বিশ্বরেকর্ড লাভে প্রয়াসী এক সীতাকুকে । “ ওরে বুদ্ধু , এখনাে যে একটা ওলিম্পিক মেডেল সাঁতার কেটে আমরা পাইনি আর এসব বুজরুকি দেখিয়ে রেকর্ড করে কি তুই দেশের মান বাড়াবি ? ”
ক্ষিতীশকে জনাচারেক চেনা লােক টেনে সরিয়ে না দিলে হয়তাে সে তখুনি জলে ঝাঁপিয়ে সম্ভাব্য বিশ্ব রেকর্ডটিকে তছনছ করে দিত । তবে সে এইটুকু মাত্র মানে , এইসব অবিরাম ব্যাপারগুলাের মধ্য দিয়ে কার কেমন সহ্যশীলতা কেমন একগুয়েমি সেটা বােঝা যায় । কিন্তু কী লাভ তাতে হয় যদি না সুশৃঙ্খল ট্রেনিং আর টেকনিকের মারফত সেগুলাে বড়ো কাজে লাগানাে হয় !
অপচয় ক্ষিতীশ এইসব অপচয় দেখে বিরক্ত বােধ করে । খুব বিরক্ত বােধ করে । কিন্তু এখন সে ছটফট করছে পার্কে যাবার জন্য । উঠে গিয়ে ঘড়ি দেখল । হিসেব কষে বার করল , কোনি প্রায় চোদ্দো ঘণ্টা হাঁটছে । এখনাে ছ - ঘণ্টা বাকি । ভয়ংকর এই শেষের ছ - ঘণ্টা । টিকতে পারবে কি ।
কুকারে রান্না চাপিয়ে ক্ষিতীশ দরজায় তালা এটে আবার বেরিয়ে পড়ল ।
পার্কে দর্শকদের সংখ্যা ক্ষীণ । গাছের ছায়ায় কিছু আর বিশ্রাম - চালায় উদ্যোক্তারা । কোনি হাঁটছে , মাথায় ছেঁড়া বেতের টুপি । ক্ষিতীশ গুনে দেখল ওরা তেরােজন । একজন বসে গেছে । পার্কে ঢুকে সে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়াল । কোনি যখন সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তখন সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে । কোনির গাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে চিবুকে চোখ দুটি বসে গেছে , গালের উঁচু হাড় দুটো আরাে উঁচু , ঠোটের চামড়া শুকনাে । কিন্তু মাথাটা তুলে যেভাবে পাতলা দেহটাকে সে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে , তাইতে ক্ষিতীশের মনে হলাে , আকাশ থেকে আগুন ঝরলেও কোনির চলা থামাবে না ।
কেন মনে হলাে , ক্ষিতীশ তা ব্যাখ্যা করতে পারবে না । শুধু এইটুকুই সে বলবে , একটা লােক নিজের সম্পর্কে কী ভাবে , সেটা বােঝা যায় চলার সময় মাথাটা সে কেমনভাবে রাখে তাই দেখে ।
ক্ষিতীশ বাড়ি ফিরল বারােটায় । লীলাবতী কথা বলছিল দোকানের দুটি মেয়ের সঙ্গে । ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল , “ হাতিবাগানের ঘর কী হলাে? ”
‘ অনেক টাকা সেলামি চায় । সম্ভব নয় । ”
সে ঘরে ঢুকে গেল । অন্যমনস্কর মতো স্নান ও খাওয়া সেরে সে ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে লাগল । তিনাট বাজার সঙ্গে সঙ্গে । আবার বেরিয়ে পড়ল ।
তেরাে থেকে আট , বসে গেছে পাঁচজন । পার্কে এখন বেশ ভিড় । লাউডস্পিকার রেকর্ড বাজানাে বন্ধ করে নানাবিধ ঘােষণায় মত্ত । তারই মাঝে প্রতিযােগীদের জানিয়ে দেওয়া হলাে , আর মাত্র পঞ্চাশ মিনিট বাকি ।
কোনি হটছে । ক্ষিতীশ জানতো ও হাঁটবে এবং শেষ করবে । ক্লান্তি ওর পদক্ষেপে ধরা পড়ছে । সকালের সেই তিনটি ছেলে এর পাশাপাশি ঘাসের উপর দিয়ে চলছে । কোনি দু'একবার ওদের কথা শুনে হাসল । ক্ষিতীশ লক্ষ করল ডান পা - টা টেনে টেনে হাঁটছে । অন্য প্রতিযােগীদের মধ্যে দুটি বছর দশেকের ছেলে , বেশ তাজাই দেখাচ্ছে ।
“ আমাদের আজকের সভাপতি বরেণ্য জননেতা ও এই সঙ্ঘের হিতষি শ্রীযুক্ত বিষ্টুচরণ ধর মহাশয় তার শত কাজ ফেলে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন । এজন্য আমরা গর্বিত । ”
ক্ষিতীশ লাউডস্পিকার থেকে কান সরিয়ে চোখ পাঠাল চালার নীচে । সেখানে টেবিলের উপর ইতিমধ্যে একটি সাদা চাদরের ও তােড়াভরা দুটি ফুলদানির আবির্ভাব ঘটেছে । তার পিহানে বসে আজকের সভাপতি ।
আরে , এ তাে গঙ্গার ঘাটে দেখা সেই হিপােটা ! ক্ষিতীশ অবাক হয়ে গেল ।
" আর কুড়ি মিনিট বাকি প্রতিযােগিতা শেষ হতে । তারপরই পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান । ”
লাউডস্পিকারে ফিসফাস আলােচনা শােনা। গেল। “ বলাতে ভুল হয়ে গেছে , পুরস্কার বিতরণের আগে সভাপতি মহাশয় তার ভাষণ দেবেন । ”
আটজনেই শেষ করল প্রতিযােগিতা । পার্কে হাজির প্রায় একশাে শিশু , বালক ও বয়স্ক ভিড় করে দাঁড়াল ঢালার সামনে । ক্ষিতীশও এগিয়ে গেল ।
তার চোখ খুঁজতে খুঁজতে কোনিকে পেল । সিমেন্টের সিঁড়ির ধাপে বসে পা ছড়িয়ে দু - হাতে টিপছে ডান উরু ।
“ ওরে বাব্বা , আর আমি হাঁটার রােসে নামছি না । দুর্ দুর্ ফাস সেকেন থাড নেই । "
“ তােকে তাে পই পই বলেছিলুম , নাম দিস না । আমি আর ভাদু একবার নেমেই টের পেয়ে গেছলুম , বােগাস ব্যাপার । ”
“ কান্তি যে বলেছিল , লােকেরা এসে পিন দিয়ে টাকা আটকে দেয় জামায় , কই দিল না তো ! ”
“ এসব ফোটোখাটো কম্পিটিশনে দেয় না । ”
“ তােকে বলেছে ! কোনি যদি ফ্রক পরে নামতাে দেখতিস , অন্তত বিশ - পঁচিশ পেয়ে যেত । প্যান্ট শার্ট পরলে তাে ওকে ছেলে দেখায় । ”
“ ঘােড়ার ডিম দিত , এখানকার লােকেরাই কঞ্জুস । ”
“ না রে , ঠিকই বলেছে ভাদুটা , আমাকে প্যান্ট পরলে ছেলেদের মতােই তাে দেখায় । এই দ্যাখ তাে চুন্ডু , প্রাইজ - ফ্রাইজ কী দেবে , পুরাে একদিন বাড়ির বাইরে , মা মেরে ফেলবে যদি কিছু হাতে করে না নিয়ে যাই । ”
লাউডস্পিকারে আনুষ্ঠানিক ঘােষণাগুলি শেষ হয়েছে । সভাপতি বিষ্টু ধর বক্তৃতা দিতে শুরু করেছে ।
ক্ষিতীশ হাত পাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে কোনিদের কথাবার্তা শুনছিল । এবার সে এগিয়ে এসে বলল, “ তুমি সাঁতার শিখবে ? ”
মুখটা তুলল সে । কাঁচা - পাকা কদমছাট চুলে ভরা মাথা আর পুরু লেনসের পিছনে জ্বলজ্বলে দুটি চোখের দিকে একটু বিরক্তভরেই তাকাল । তারপর আবার সে নিজের পা টিপতে লাগল ।
“ শিখবে সাঁতার ? ”
“ সাঁতার আমি জানি । ”
“ না , জানাে না । ”
ঝটকা দিয়ে চুল ঝাঁকিয়ে কোনি আবার মুখ তুলল।
“ আপনি জানেন ? ”
“ হ্যাঁ জানি । আমি দেখেছি তােমায় গঙ্গায় । ও সাঁতার চলবে না । সাঁতার শেখার জিনিস । ”
“ যা জানি তাতেই গঙ্গার এপার - ওপার করতে পারি , শেখার আবার আছে কী ? "
“ অনেক কিছু শেখার আছে । ”
“ আমার দরকার নেই শিখে , যা জানি তাই যথেষ্ট । ”
ক্ষিতীশের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে কোনি দাঁড়াল । চেঁচিয়ে ডাকল , ' অ্যাই গােপলা শুনে যা । ”
টেবিলে স্তপীকৃত নানাবিধ প্রাইজগুলাের দিকে তাকিয়ে থাকা খালি পা , ছেড়া গেঞ্জি গায়ে বছর বারাের একটি ছেলে এগিয়ে এল । "
“ হ্যা রে , মা কিছু বলেছে ? ”
“ যাও না বাড়িতে , পিটিয়ে তােমার চামড়া তুলে নেবে । ”
“ দাদা ”
দাদা আজ কাজে যায়নি , জ্বর হয়েছে । মার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে তােমাকে নিয়ে । দাদা বলেছে , বেশ করেছে কোনি । ”
ক্ষিতীশ ভাবল , আর একবার কোনির সঙ্গে কথা বলবে । কিন্তু ততক্ষণে কোনিকে ডেকে নিয়ে গেছে নেতাজি বালক সঙ্ঘের কর্মকর্তারা । প্রতিযােগীদের হাতে একটি করে খাবারের ঠোঙা দেওয়া হচ্ছে ।
“ এই যে শরীর , একে চাকর বানাতে হবে । ”
ক্ষিতীশ ফিরে তাকাল বক্তৃতাকারীর দিকে । মাইক্রোফোনের পিছনে একটি ধুতি - পাঞ্জাবি পরা চর্বির টিগি । ক্ষিতীশ ভিড় কেট চাতালের দিকে এগােল ।
“ কী করে তা সম্ভব ? আপনার লক্ষ লক্ষ টাকা আছে কিন্তু পারেন কি আপনি আর্চ করতে , পিকক্ হাতে ? যদি কেউ আপনাকে চাঁটি মেরে পালায় , পারবেন কি তাকে দৌড়ে গিয়ে ধরতে ? না , পারবেন না , আমি জানি আপনি পারবেন না । ”
সভাপতির পিছন থেকে কণ্ঠস্বর শােনা গেল , “ একবার পরীক্ষা করে দেখব নাকি ? ”
বিছু ধর পিছন দিকে তাকাল । ক্ষিতীশাকে দেখে ভ্রু কোচকাল । মাইকে হাত চাপা দিয়ে চাপা গলায় বলল , “ সব জায়গায় ইয়ারকি করবেন না । তারপর হাত সরিয়ে বলতে শুরু করল , “ কেন পারবেন না , জানেন কি কারণটা ? ” কারণ , আপনার শরীর ফিট নয় । আর ফিটনেস আসে নিয়মিত ব্যায়াম থেকে । ”
বিষ্টু ধর পিছন ফিরে তাকাল । ক্ষিতীশ মাথা হেলিয়ে তারিফ জানাল ।
“ ব্যায়াম সেইজন্যই সকলের করা দরকার । হাঁটাও একটা ব্যায়াম । তাই নেতাজি বালক সঙ্ঘের তরুণ কর্মীদের , যারা দিনরাত পরিশ্রম করে আজকের এই প্রতিযোগিতাকে সফল করে তুলেছে , তাদের বললাম তােমরা হাঁটার ব্যবস্থা করাে , আমি আছি তােমাদের সাথে । এটা সমাজসেবার কাজ , আমি থাকব তােমাদের পাশে পাশে । "
“ উহু , আগে আগে । নেতৃত্ব দিতে হলে সামনে থাকতে হয় । ”
বিষ্টু ধর পিছনে তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকাল । তারপর মাথা হেলাল , “ পাশে পাশেই বা বলি কেন , আমি থাকব আগে আগে । সমাজের কল্যাণের জন্য মানুষকে সুস্থ সবল করার জন্য যখনই সংগঠন গড়ে উঠবে , সবার আগে আমাকে ছুটে আসতেই হবে । "
“ ছােটার কথা চেপে যান । ” পিছন থেকে ফিসফাস শােনা গেল , “ যদি কেউ বলে একটু ছুটে দেখান । ”
বিষ্টু ধর ঢোক গিলে বলল , " কিন্তু ছুটেই বা আসব কেন ! মানুষ ছােটে কখন ? যখন সে ভয় পায় , দিশাহার হয় । কিন্তু জনগণ সহায় থাকলে আমি ভয় পাব কেন ? জনগণই পথ বলে দেবে , সুতরাং দিশাহারা হব কেন ? না , আপনাদের আশীর্বাদ থাকলে আমি ভয় পাব না । সঠিক পথেই আপনাদের সেবা , দেশের ও দশের সেবা করে যেতে পারব । তাই আজ প্রতিযােগীদের এই কথা বলেই বক্তব্য শেষ করব , শরীরটাকে ফিট না করলে পরিশ্রম করতে পারবে না । পরিশ্রম না করলে দেশ গড়ে তুলতে পারবে না । তাই আজ যে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তোমরা হাঁটা শুর। করাল....”
বিষ্টু ধর পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াতে লাগল । “ এই যে এটা , এ হাঁটা জীবনের পথে....”
বিষ্টু ধর অসহায়ভাবে পিছনে তাকাল ।
“ ভুলে গেছেন ? ”
ঘাড় নেড়ে অসহায়ভাবে বিষ্টু ধর ফিসফিস করে বলল , “ রবি ঠাকুরের একটা পদ্য লিখে এনেছিলুম , পাচ্ছি না । ”
“ বলুন এই যে যাত্রা শুধু হলাে ছোট্ট এই পার্কে - ”
মাইক্রোফোনে গমগম করে উঠল সভাপতির আবেগভরা কন্ঠ , “ এই যে যাত্রা শুরু হলাে , ছােট্ট পার্কে”
“ ধীরে ধীরে তা বৃহত্তর জীবনের দিকে , সুখ - সমৃদ্ধিভরা জীবনের দিকে তােমাদের নিয়ে যাক । এই পার্ক পরিক্রমা রূপান্তরিত হােক বিশ্ব পরিক্রমায় , জয় হিন্দ । ”
বিষ্টু ধর হুবহু বলে গেল ক্ষিতীশের প্রম্পট্ শুনে । শুধু জয় হিন্দের পর গলা কাপিয়ে যােগ করল , “ ইনকিলাব জিন্দাবাদ । ”
পুরস্কার দেওয়া হলাে : প্লাস্টিকের কিট ব্যাগ আর তােয়ালে পেল যারা ২৪ ঘন্টা সম্পূর্ণ করেছে । ১৬ ঘন্টার পরে যারা অবসর নিয়েছে তাদের শুধুই ব্যাগ আর ১২ ঘন্টার পরে যারা তাদের তাদের শুধুই তােয়ালে । কোনি পুরস্কার নিয়ে ব্যাগটা উলটপালটে দেখল । সভাপতিকে নমস্কার জানানোর দরকারও মনে করল না । খাবারের ঠোঙাটা ব্যাগের মধ্যে ' ভরে সে ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল , “ বাড়ি যাই , এটা মাকে দিতে হবে । ”
ভাইয়ের কাধে হাত রেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনি চলে যাচ্ছে ।
ক্ষিতীশ একদৃষ্টে তাকিয়ে । মাথাটা উঁচু , কঞ্চির মতাে শরীরটা দুলছে । সঙ্গে ওর বন্ধু ভাদু আর চণ্ডু। পার্ক থেকে বেরিয়ে ও ধীরে ধীরে দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে । ক্ষিতীশের মনে হলাে , ওর বাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে রাখলে হতাে ।
“ আপনাকে বেষ্টাদা ডাকছে । ”
“ কে বেষ্টাদা ? ” অন্যমনস্ক ক্ষিতীশ বলল ।
“ আজ যিনি সভাপতি । ”
ক্ষিতীশকে দেখেই বিষ্টু ধর একগাল হেসে বলল , “ ফিনিশিংটা , সবাই বলছে দারুণ হয়েছে । ” তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল , “ ইনকিলাব জিন্দাবাদটা অ্যাড় করলুম , তার কারণ আছে । আমার প্রগ্রেসিভ নেচারটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার । চলুন চলুন , আমার গাড়ি রয়েছে , আপনাকে সব বলছি , আমার বাড়ি চলুন । ”
বিষ্টু ধর আগামী নির্বাচনে দাঁড়াবে । তাই এখন থেকেই সে তােড়জোড় শুরু করেছে । পাড়ায় পাড়ায় নানান ব্যাপারে টাকা দিয়ে অনুষ্ঠান করাচ্ছে আর তাতে সভাপতি হয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে । নির্দলীয় সমাজসেবক হিসাবে সে ভোট চাইবে ।
বিষ্টু ধর গাড়িতে বসে কথাগুলাে জানিয়ে দিল ।
বাড়ি পৌঁছে বলল , “ আপনাকে আমার দরকার । ”
“ আমাকে ! ”
“ হ্যাঁ , আপনি আমার ইস্পিচ - রাইটার হবেন , বক্তৃতা লিখে দোবেন । অবশ্য এজন্য টাকা দেবাে। রাজি ? ”
“ আমি তাে খেলার ব্যাপার ছাড়া আর কিছু জানি না । ” ক্ষিতীশ বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে বলল ।
“ সেইজন্যেই তাে আপনাকে চাই । খেলা নিয়েই বক্তৃতা দিতে চাই , আর কিছু নিয়ে নয় । বিনােদ ভড় হচ্ছে সিটিং এম এল এ । খেলার লাইনের লােক । অনেক ক্লাবের প্রেসিডেন্ট । আমিও খেলার লাইন ধরে ক্যাম্পেন করব । বিনােদ ভড় মিনিস্টার হতে চাই ”
সিঙ্গারা মুখে দিয়ে ক্ষিতীশ বলল , “ ভেবে দেখি ।”
