ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক |
লেখক -: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখকের পরিচিতি -:
জন্ম: ১২ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া-মুরারিপুর গ্রামে নিজ মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বনগাঁ'র নিকট বারাকপুর গ্রামে।
মৃত্যু: ১লা নভেম্বর, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে।
-উনি চালতেবাগানের মাঠের ধারে বসে রােজ কী করেন । বােধ হয় লেখেন । কবিমানুষ কিনা । আমি একদিন সতুর সঙ্গে দেখতে গেলাম ব্যাপারটা । চালতেবাগান বহুকালের প্রাচীন আম তেঁতুল গাছের ছায়ায় দিনমানেই সন্ধ্যার মতাে অন্ধকার । অনেক রকম মােটা লতা গাছে গাছে জড়াজড়ি করে আছে । বাগান পার হয়েই একটা ছােটো মাঠ , উমাচরণ মাস্টার সে মাঠের ধারে বসে আছেন , বাগানের ছায়ার আশ্রয়ে একটা ছেড়া মাদুর পেতে । মাদুরের ওপর কাগজ বই ছড়ানাে । পাছে উড়ে যায় বলে মাটির ছােটো ছােটো ঢেলা চাপানাে সেগুলাের ওপর । আমরা শ্যাওড়া ঝােপের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম , তিনি কখনও উপুড় হয়ে কী লিখছেন , কখনও সামনের মাঠের দিকে চেয়ে কী ভাবছেন , কখনও আপনমনে হাসছেন , বিড় বিড় করে কী বকছেন ।
সতু সসম্ভ্রমে চুপি চুপি বললে – দেখলি ? কবিমানুষ ।
আমি বললাম – কী করছেন?
-লিখছেন ।
- বিড় বিড় করে কী বকছেন ?
– ও রকম কবিরা করে থাকে ।
দুজনে চুপ করে দাঁড়িয়ে কবির কাও অনেকক্ষণ দেখলাম । এই আমার জীবনে প্রথম একজন জীবন্ত কবির । ক্রিয়াকলাপ দেখবার দুর্লভ সৌভাগ্য ঘটল । মনে আছে , শ্যাওড়া ঝােপের পাশেই ছিল বড়াে একটা কতবেল । গাছ , তলা বিছিয়ে পড়ে ছিল পাকা পাকা কতবেল । সেই বয়সের লােভ , বিশেষ করে কতবেলের ওপর লােভ অমন করেছিলাম । কবি দেখবার আনন্দে ও বিস্ময়ে । উমাচরণ মাস্টারের বয়স তখন কত ? আমার মনে হয় চল্লিশের ওপর । কারণ আমার মায়ের বড়াে ভাই , আমার বড়াে মামা – যাঁর বয়স তখন শুনতাম পঁয়ত্রিশ - তিনি মাস্টারমশায়কে ‘ দাদা ” বলে ডাকতেন ।
আমরা যেমন নিঃশব্দে সেখানে গিয়েছিলাম তেমনই নিঃশব্দে চলে এলাম মনে বিস্ময় ও আনন্দ নিয়ে । এর পরে উমাচরণ মাস্টার যখন পড়াতেন , তখন হাঁ করে তার দিকে চেয়ে দেখতাম । একজন কবি বটে । উনি ঠিকই বলেছেন – বড়াে বড়াে লােকেরা প্রথম জীবনে মাস্টারি করে । ওঁর বয়স বেশি হয়েছে বটে কিন্তু উনি একজন কবিও তাে হয়েছেন । সারদাটা কিছুই বােঝে না । বছরখানেক কাটল । আমরা কটি ছেলে উচ্চ প্রাইমারি পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরি হয়েছি । সেই বছর উমাচরণ মাস্টার আমাদের নিয়ে রানাঘাটে যাবেন পরীক্ষা দেওয়াতে । চারটি ছেলে – মনে আছে চৰুক্তিদের কানাই , আমি , সতু ও সারদা । দুর্গাপুর থেকে হেঁটে বেরিয়ে শাবলতলার মাঠে যখন পড়েছি , তখন দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে ।
বড্ড মনে আছে সেই অপরাহের কথাটি । তখন শাবলতলার মাঠে ঝাঁ ঝাঁ করছে রােদ্র । মস্ত বড়াে মাঠের এখানে ওখানে কুলগাছ শ্যাওড়া - ভঁাটা আর বনতুলসীর জঙ্গল । ধু ধু করছে মাঠ যেন সমুদ্রের মতাে , কূলকিনারা নেই কোনাে দিকে । এত বড়াে মাঠ কখনও দেখিনি । দুর্গাপুর থেকে শাবলতলার মাঠ প্রায় দু ক্রোশ আড়াই ক্রোশ পথ । কাছাকাছি কোনাে গ্রাম নেই এ মাঠের কোনাে দিকে । একটা সরু মেঠো পথ মাঠের মধ্যে দিয়ে দূরে কোথায় চলে গিয়েছে । কী একটা ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছে দুপুরের রােদে । আমরা সবাই ছেলেমানুষ , ক্লান্ত হয়ে পড়েছি । উমাচরণ মাস্টার বললেন - যাও সব গাছতলায় একটু বাস নাও ।
আমাদের প্রত্যেকের কাধে একটা করে বোঁচকা । তার মধ্যে আমাদের বই - দপ্তর আছে , কাপড় গামছা ও কথা আছে । থাকতে হবে নাকি হােটেলে । আমরা বোঁচকা নামিয়ে একটা কুলগাছের তলায় সবাই বসলাম । মাস্টারমশায় বললেন - দেখাে তাে কুল হয়েছে কিনা ।
সতু দেখে বললে- কুল হয়েছে , ছােটো ছােটো -খাওয়া যায় না ।
কানাই - এর মা ওকে সেখানে গিয়ে খাবার জন্যে নারকেলের নাড়ু আর রুটি করে দিয়েছিলেন পুটুলিতে । সতু ওর কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে খেলে । আমি চাইতে গেলাম , কানাই বললে , নেই ।
আমরা একটু পরে সবাই বোঁচকা রেখে হুটোপাটি করে মাঠের মধ্যে বনতুলসীর জঙ্গলে খেলা করতে লাগলুম । কী সুন্দর যে লাগছিল । ক্ষুদ্র প্রামের পাড়ায় পাড়ায় খেলা করে বেড়াই , এত বড়াে মাঠের এত ফাকা জায়গায় খেলা করবার সুযােগ কখনও পাইনি । ওদের কেমন লাগছিল জানি না , আমার মনে হচ্ছিল যেন কোনাে নতুন রাজ্যে রূপকথার জগতে এসে পড়েছি - তুলসীমঞ্জরীর সুগন্ধভরা অপরাহ্বের বাতাসে যেন কোন সুদূরের ইঙ্গিত ।
যে দেশ কখনও দেখিনি , তার কথা কিন্তু আমার মনে সর্বদাই উঁকি দেয় , আজ এই শাবলতলার মাঠে এসে সেই দূর - দূরান্তকে দেখতে পেলাম । ঝোপে ঝােপে শালিক আর ছাতারে পাখির কলরব , এখানে ওখানে বেলে জমিতে খেঁকশেয়ালের গর্ত , রাঙা কেলেঝোড়া ফুলের লতা জড়িয়ে উঠেছে বুনাে চটকা আর তিম্ভিরাজ গাছে , জনমানুষের বাস নেই , একটা কলা গাছ কি আম গাছ চোখে পড়ে না , যেন এ জগতে মানুষের বাস নেই , শুধুই বনঝােপের শুকনাে পাতার ওপর দিয়ে মচ মচ করে পাতার ধুলাে উড়িয়ে এ দেশে চলে যাও , লেখাপড়ার বিরক্তিকর বাধ্যতা এখানে নেই । খেলা ছেড়ে লেখাপড়া করতে কেউ বলবে না এ দেশে । উমাচরণ মাস্টার সেই পুরােনাে , একঘেয়ে , বালকের পক্ষে মহা বিরক্তিকর জগতের মানুষ , এ নতুন জীবনের উদাস মুক্তির মধ্যে , দিনরাতব্যাপী খেলা আর অবকাশের মধ্যে ওঁর স্থান নেই আদৌ।
বেলা পড়ে এসেছে । হঠাৎ সতু বললে হারে , মাস্টারমশাই কোথায় রে ?
আমি বললাম কেন , -কুলতলায় নেই ?
– কতক্ষণ তাে তাকে দেখছি নে । গেলেন কোথায় ? আমাদের যেতে হবে না ইস্টিশনে ? দু ঘণ্টার ওপর তাে এখানে আছি । গাড়ি ধরতে হবে না ?
আমার মনে হচ্ছিল গাড়ি ধরে আর কি রাজা হব আমরা ! এই তাে বেশ আছি , উচ্চ প্রাইমারি পরীক্ষার বিভীষিকার মধ্যে না - ই বা গেলাম । ইন্সপেক্টর এসে সেবার স্কুলে বলে গিয়েছিল রানাঘাটে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ায় নাকি নানা গােলমাল । খাতায় লিখে পরীক্ষা হয় , গার্ড আছে সেখানে ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে , একটু যে দেখাদেখি করবে কী বলাবলি করবে তার কোনাে উপায় নেই । বলাবলি করলেই মহকুমার হাকিমের সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করবে , তিনি জেলও দিতে পারেন , জরিমানাও করতে পারেন । একটু ফিসফাস করবার জো নেই সেখানে । নবমীর পাঁটার মতাে কাপতে কাপতে ঢুকতে হবে হলঘরে । কী ভীষণ পরিণাম ছাত্রজীবনের !
সত্যি বলছি , শালতলার মাঠ দেখবার পরে , এখানে এসে এই দু ঘণ্টা ছুটোছুটি করে বেড়ানাের পরে পথ । কাছাকাছি কোনাে গ্রাম নেই এ মাঠের কোনাে দিকে । একটা সরু মেঠো পথ মাঠের মধ্যে দিয়ে দূরে কোথায় চলে গিয়েছে ।
কী একটা ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছে দুপুরের রােদে । আমরা সবাই ছেলেমানুষ , ক্লান্ত হয়ে পড়েছি । উমাচরণ মাস্টার বললেন - যাও সব গাছতলায় একটু বিশ্রাম নাও । আমাদের প্রত্যেকের কাধে একটা করে বোঁচকা । তার মধ্যে আমাদের বই - দপ্তর আছে , কাপড় গামছা ও আছে ।
থাকতে হবে নাকি হােটেলে । আমরা বোঁচকা নামিয়ে একটা কুলগাছের তলায় সবাই বসলাম । মাস্টারমশায় বললেন - দেখাে তাে কুল হয়েছে কিনা । সতু দেখে বললে কুল হয়েছে , ছােটো ছােটো । খাওয়া যায় না । কানাই - এর মা ওকে সেখানে গিয়ে খাবার জন্যে নারকেলের নাড়ু আর রুটি করে দিয়েছিলেন পুটুলিতে । সতু ওর কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে খেলে । আমি চাইতে গেলাম , কানাই বললে , নেই । আমরা একটু পরে সবাই বোঁচকা রেখে হুটোপাটি করে মাঠের মধ্যে বনতুলসীর জঙ্গলে খেলা করতে লাগলুম । কী সুন্দর যে লাগছিল । ক্ষুদ্র প্রামের পাড়ায় পাড়ায় খেলা করে বেড়াই , এত বড়াে মাঠের এত ফাকা জায়গায় খেলা করবার সুযােগ কখনও পাইনি । ওদের কেমন লাগছিল জানি না , আমার মনে হচ্ছিল যেন কোনাে নতুন রাজ্যে রূপকথার জগতে এসে পড়েছি তুলসীমঞ্জরীর সুগন্ধভরা অপরাহ্বের বাতাসে যেন কোন সুদূরের ইঙ্গিত ।
যে দেশ কখনও দেখিনি , তার কথা কিন্তু আমার মনে সর্বদাই উঁকি দেয় , আজ এই শাবলতলার মাঠে এসে সেই দূর - দূরান্তকে দেখতে পেলাম । ঝোপে ঝােপে শালিক আর ছাতারে পাখির কলরব , এখানে ওখানে বেলে জমিতে খেঁকশেয়ালের গর্ত , রাঙা কেলেঝোড়া ফুলের লতা জড়িয়ে উঠেছে বুনাে চটকা আর তিম্ভিরাজ গাছে , জনমানুষের বাস নেই , একটা কলা গাছ কি আম গাছ চোখে পড়ে না , যেন এ জগতে মানুষের বাস নেই , শুধুই বনঝােপের শুকনাে পাতার ওপর দিয়ে মচ মচ করে পাতার ধুলাে উড়িয়ে এ দেশে চলে যাও , লেখাপড়ার বিরক্তিকর বাধ্যতা এখানে নেই ।
খেলা ছেড়ে লেখাপড়া করতে কেউ বলবে না এ দেশে । উমাচরণ মাস্টার সেই পুরােনাে , একঘেয়ে , বালকের পক্ষে মহা বিরক্তিকর জগতের মানুষ , এ নতুন জীবনের উদাস মুক্তির মধ্যে , দিনরাতব্যাপী খেলা আর অবকাশের মধ্যে ওঁর স্থান নেই আদৌ । বেলা পড়ে এসেছে । হঠাৎ সতু বললে হারে , মাস্টারমশাই কোথায় রে ? আমি বললাম কেন , কুলতলায় নেই ?
– কতক্ষণ তাে তাকে দেখছি নে । গেলেন কোথায় ?
আমাদের যেতে হবে না ইস্টিশনে ? দু ঘণ্টার ওপর তাে এখানে আছি । গাড়ি ধরতে হবে না ? আমার মনে হচ্ছিল গাড়ি ধরে আর কি রাজা হব আমরা ! এই তাে বেশ আছি , উচ্চ প্রাইমারি পরীক্ষার বিভীষিকার মধ্যে না - ই বা গেলাম । ইন্সপেক্টর এসে সেবার স্কুলে বলে গিয়েছিল রানাঘাটে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ায় নাকি নানা গােলমাল । খাতায় লিখে পরীক্ষা হয় , গার্ড আছে সেখানে ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে , একটু যে দেখাদেখি করবে কী বলাবলি করবে তার কোনাে উপায় নেই । বলাবলি করলেই মহকুমার হাকিমের সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করবে , তিনি জেলও দিতে পারেন , জরিমানাও করতে পারেন । একটু ফিসফাস করবার জো নেই সেখানে । নবমীর পাঁটার মতাে কাপতে কাপতে ঢুকতে হবে হলঘরে ।
সত্যি বলছি , শালতলার মাঠ দেখবার পরে , এখানে এসে এই দু ঘণ্টা ছুটোছুটি করে বেড়ানাের পরে আমি যেন জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি। তা হচ্ছে এই রকম বিশাল মুক্ত বনময় ধুলিভরা মাঠের অবাধ শান্তি আর স্বাধীনতার মধ্যে খেলা করে বেড়ানাে । পরীক্ষা দিয়ে কী হবে ! কানাই এসেও বললে – আমরা যাব কখন ? মাস্টারমশাই কোথায় ?
সত্যিই তাে , তাঁকে কোনাে দিকে দেখা যাচ্ছে না । সবাই মিলে খুঁজতে বার হওয়া গেল । সতু ডাকতে লাগল – ও মাস্টারমশাই , মাস্টার মশা - ই
কোনাে সাড়া নেই ।
সতু ভীতুমুখে বলল – বাঘে নিয়ে গেল নাকি রে ?
কানাই বললে – দূর , এখানে মানুষখেকো বাঘ থাকবে ?
– না , নেই । তােকে বলছে !
– তবে গেলেন কোথায় ?
আমি বললাম - তােমরা খুঁজে দেখাে । আমি এখানে খেলা করি ।
এমন সময় সারদা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল – শীগগির – শীগগির আয় – দেখে যা -
আমরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠেলাম – কী হয়েছে রে ? বেঁচে আছেন
তাে ?
কথা বলতে বলতেই আমরা সারদার পেছনে ছুটলাম । বেশ খানিকটা দুর দৌড়ে সারদা থেমে পড়ল এবং আঙুল দিয়ে সামনের দিকে দেখিয়ে আমাদের চুপ করতে বলে পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল ।
একটা শুকনাে খাল - মতাে নীচু জায়গায় কুঁচঝোপের আড়ালে উমাচরণ মাস্টার বসে বসে ঝুঁকে পড়ে লিখতে লিখতে বিড় বিড় করে আপনমনে কী বলছেন , এমন কী আপনমনে ফিক ফিক করে হাসছেনও । যে কেউ দেখলে বলবে উন্মাদ পাগল । অমন তন্ময় হয়ে লিখতে আমরা তাকে কখনও দেখিনি , অমন ভাবে আপনমনে হাসতেও তাকে কখনও
দেখিনি ।
সতু মুগ্ধদৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে বললেন-মাস্টারমশাই একজন আসল
কবি ।
সারদা ওর মতে মত দিয়ে বললেন – ঠিক তাই ।
কানাই ও আমি কোনাে কথা না বলে একদৃষ্টে এই সত্যিকার জীবন্ত কবিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম ।আমাদের কত ভাগ্যি যে আমরা এমন মাস্টার পেয়েছি ।
কানাই একটু পরে বললে – কিন্তু ভাই , সন্ধে হলাে । ওঁকে না ডাকলে আমাদের উপায় কী হবে ? ডাকি ওঁকে । কী বলিস ?
কেউ সাহস করে না ।
সারদার মনে কবির প্রতি শ্রদ্ধা একটু ফিকে , সে দু - একবার আমাদের উপস্থিতি জ্ঞাপক কাশির আওয়াজ করলে ।
সতু চুপি চুপি বললে – এই ! আস্তে ।
সারদা বললে – হ্যা , আস্তে বই কী । আমরা মরি এখন এই মাঠের মধ্যে সন্ধেবেলা ! বাঘে ধরুক সবসুদ্ধ – বলে সজোরে একবার কাশির আওয়াজ করতেই উমাচরণ মাস্টার চমকে পেছন ফিরে চাইলেন ।
সারদা বললে – আসুন মাস্টারমশাই , সন্ধের দেরি নেই যে – ইস্টিশান এখনও অনেকখানি রাস্তা -
উমাচরণ মাস্টার ব্যস্ত হয়ে খাতাপত্র গুটিয়ে বগলে করে নিয়ে আমাদের কাছে উঠে এলেন শুকনাে খাল থেকে । অপ্রতিভের হাসি হেসে বললেন – তাই তাে , বেলা গিয়েছে দেখছি । চল চল !
তারপর পেছনদিকে চেয়ে বললেন – জায়গটিা বড়াে চমৎকার - না ?
সতু সশ্রদ্ধ সুরে বললে – ওখানে কী করছিলেন মাস্টারমশাই ? কী আছে ওখানে ?
উমাচরণ মাস্টার ধমক দিয়ে বললেন – সে কী তুই বুঝবি ? সিনারি কাকে বলে জানিস ? চমৎকার সিনারি ওখানটাতে । কবিতা লিখছিলাম । কী চমৎকার মাঠটা , বুঝিস কিছু
আমারও চোখে যে এই অপরাত্নে এই মাঠ অদ্ভুত ভালাে লেগেছে , মাস্টারমশায়ের কথার মধ্যে তার সায় পেয়ে আমার মন খুশিতে ভরে উঠল । আমি নতুন দৃষ্টি পেলাম সেই দিনটিতে , উচ্চ প্রাইমারি পরীক্ষা দিতে যাবার পথে । উমাচরণ মাস্টার কত বড়াে শিক্ষকের কাজ করলেন সেদিন – তিনি নিজেও কি তা বুঝলেন ?
আমার কথা এখানেই শেষ । উমাচরণ মাস্টারের ইতিহাসও এখানেই শেষ । প্রায় ত্রিশ - বত্রিশ বছর আগের কথা সেসব । উমাচরণ মাস্টার আজ আর বােধ হয় বেঁচে নেই । বড়াে হয়ে উমাচরণ চক্রবর্তী বলে কোনাে কবির লেখা কোথাও পড়িনি বা কারও মুখে নামও শুনিনি । তাতে কিছু আসে যায় না । যশােভাগ্য সকলের কি থাকে !
আজ এতকাল পরে শাবলতলার মাঠে এসে আবার মনে পড়ে গেল বাল্যের সেই অপূর্ব অপরাহ্বের কথা , মনে পড়ে গেল উমাচরণ মাস্টারকে । দুঃখ হলাে দেখে – সে শাবলতলার মাঠ একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে । মুছে গিয়েছে সে সৌন্দর্য , সে নির্জনতা । উমাচরণ মাস্টারের জন্যে মনটা এতদিন পরে যেন কেমন করে উঠল ।