ভারতবাসীর আহার (Bharatabasira ahara) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় - সাহিত্য সঞ্চয়ন দশম শ্রেণী উৎস সন্ধানে

ভারতবাসীর আহার - আশাপূর্ণা দেবী দশম শ্রেণির বাংলা গল্প - সাহিত্য সঞ্চয়ন দশম শ্রেণী উৎস সন্ধানে | bharatabasira-ahara pdf download by wbgolpo ।

 

ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদ

       লেখক :- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়

র পাঁচটা বিষয়ে যেমন, অশনভূষণেও ভারতবর্ষ বিচিত্র বিভিন্নতার দেশ— যদিও এই বিভিন্নতার মধ্যেও একটা অন্তর্নিহিত যোগসূত্রের একতা আছে। প্রাকৃতিক আবেষ্টনী জলবায়ু, খাদ্যবস্তুর সমাবেশ, এ সব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার ফলে, পাঞ্জাব, উত্তর- ভারত, বাংলা, মহারাষ্ট্র, দক্ষিণ ভারত, নেপাল প্রভৃতি অঞ্চলের খাবার আলাদা আলাদা ধরনের। ইউরোপে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধরে সমগ্র মহাদেশটাকে দুটো প্রধান ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা উত্তর ইউরোপ, আর তার চেয়ে গরম দক্ষিণ ইউরোপ। উত্তর

ইউরোপে লোকে বেশি করে গোরু পোষে। ও অঞ্চলে মাখনটাই সাধারণত ওরা বেশি করে খায়, মাখন দিয়ে (আর অভাবে শুত্তরের চর্বি দিয়ে) ভাজা বস্তুই বেশি প্রচলিত, আর তা ছাড়া, পানীয় হিসাবে যব থেকে তৈরি বিয়ার মদ উত্তরের দেশে বেশি খায়। দক্ষিণ ইউরোপ হচ্ছে ছাগলের দেশ, আর ঐ অঞ্চলে জলপাই গাছ খুবই হয়। জলপাইয়ের তেল সাধারণত রান্নায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে, আঙুরও ফলে অজস্র, সেইজন্য আঙুরের রসে তৈরি মদ সকলেই খায়। খাবারের এই রকমফের দেখে, উত্তর ইউরোপের সম্বন্ধে বলা হয় Beer and Butter Area, 

আর দক্ষিণ ইউরোপের সম্বন্ধে Wine and Olive Oil Area। ভারতবর্ষকে মোটামুটি এই ধরনে ভাগ করা যেতে পারে— পাঞ্জাব, উত্তর ভারত, মহারাষ্ট্রের শুখনো অঞ্চল, আর সমুদ্রের উপকূলের বর্ষার দেশ: আর সাধারণ খাওয়া ধরে উত্তর অঞ্চলের নাম করা যায় Wheat and Dal and Ghee Area অর্থাৎ রুটি দাল আর ঘিয়ের দেশ, আর বাংলা, উড়িয়া, আসাম, মাদ্রাজ, বোম্বাইয়ের কেরলের সমুদ্রতীরের অঞ্চলগুলিকে বলা যায়। • Rice & Fish and Oil Area । অর্থাৎ ভাত, মাছ, তেলের দেশ। অর্থাৎ ভাত, মাছ, তেলের দেশ। এই তেল সব জায়গায় একই নয়, বাংলা, আসাম, উড়িষ্যায় সরষের তেল, অন্ধ্র কর্ণাট, তামিলনাড়ুতে তিলের তেল, কেরলে নারকলের তেল ঘী খাইয়েরা এর একটাও পছন্দ করে না (আজকার 'ভেজিটেবল ঘী'র কল্যাণে এ বিষয়ে ভারত সমভূম হয়ে যাচ্ছে। ভারতের আহারে এর আগমনে এক ধরনের বিপ্লব এসে গিয়েছে)।

খাওয়া-দাওয়ায় পার্থক্য অল্প বেশি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে থাকলেও, কতকগুলি ব্যাপারে এই খাওয়া-দাওয়াতেও একটা নিখিল ভারতীয় সাম্য দেখা যায়। ভারতীয় খাদ্যের প্রথম কথা— এতে নিরামিষের আধিপত্য। ভারতের সাধারণ খাওয়া, জাতীয় আহার হচ্ছে দাল ভাল বা দাল-রুটি (এই রুটি কোথাও গমের আটা থেকে হয়, কোথাও বা যব থেকে, কোথাও আবার বাজরা বা মাড়ুয়া থেকে)। দালে একটু মশলা আর তেল বা ঘী থাকা চাই। ভারতের National Dish - জনপ্রিয় খাদ্য হচ্ছে ভাত আর তরকারি, তা সে নিরামিষ দাল বা সবজির ঝোল, ডালনা, - শুকতোই হোক, বা মাছ মাংসের তরকারিই হোক। আন্তর্জাতিক খাদ্য তালিকায় ভারতবর্ষ থেকে দুটি জিনিস গৃহীত হয়েছে, প্রায় সব দেশের রেস্তোরায় এই খাবার কখনও না কখনও পরিবেশিত হয়ে থাকে, আর লোকে আগ্রহ করে খায়ও। সে দুটি হচ্ছে Rice and Curry অর্থাৎ মশলা-দেওয়া তরকারি (মাংস, ডিম বা মাছের) আর ভাত, আর Chutney অর্থাৎ মশলাদার টক-মিষ্টি চাটনি। এছাড়া, দক্ষিণ ভারতের ঝাল-টক দালের সুপ- যাকে 'রসমা বলে, সেটাও একটি ইংরেজ-পছন্দ খাদা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তামিলে এর নাম “মুলগুতনীর" অর্থাৎ লঙ্কার জল, Pepper water, এই নাম ইংরেজের মুখে হয়ে দাঁড়িয়েছে Mulliga tawney soup |

আরও কতকগুলি খাবারের জিনিস আছে, যেগুলি অতি প্রাচীনকাল থেকেই সমগ্র ভারতে জনপ্রিয় খাদ্য, তবে ভারতের বাইরে কারি ভাত আর চাটনির মতো এতটা প্রসার লাভ করেনি। যেমন, খিচুড়ি – এটি সর্বত্রই প্রচলিত, কিন্তু ভারতের বাইরে দাল তেমন চলে না বলে খিচুড়ি বাইরের লোকেদের পছন্দসই হওয়া কঠিন। আর একটি ভারতীয় খাদ্য হচ্ছে পায়স বা পরমান প্রচুর খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি হলে এটি একটি দেবভোগ্য খাদ্য হয়, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য আর অস্তিক-প্রাচ্য দেশ ছাড়া যেমন আরব দেশ, গ্রিস- অন্যত্র এই পায়েসের তেমন রেওয়াজ নেই। ভারতের লুচি বা পুরিও তেমন বাইরে নিজের স্থান করে নিতে পারেনি।

ভারতবর্ষের পাকপদ্ধতির কৃতিত্ব বেশির ভাগ হচ্ছে নিরামিষ খাদ্য নিয়ে, আর নিরামিষের মধ্যে ভারতবর্ষ কতকগুলি ভালো মিষ্টান্নের সৃষ্টি করেছে, কিন্তু সেগুলিও জগৎ জোড়া হতে পারেনি। ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলের মাছের রান্নার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আর তার আছে, যেমন বাংলাদেশে। মাংস রান্নায় ভারতবর্ষ ইরানের অনুকরণই বেশি করেছে। ইরানের রান্নায় মশলার একটু আধিক্য হয়ে সৃষ্টি হয়েছে ভারতের মোগলাই রান্না রন্ধনজগতে এর একটা নিজস্ব স্বতন্ত্র স্থান আছে।

ভারতবর্ষ মুখ্যত নিরামিষ ভোজীর দেশ। মাছ মাংস যারা খায়, তাদের সংখ্যা অবশ্য কম নয়। কিন্তু অন্য দেশের তুলনায় মাংস খাওয়াটা এদেশে খুবই কম। যারা খায়, তারা আবার প্রত্যেক দিন খায় না, বা পায় না। এ দেশে নিরামিষ খাদ্য-শস্য, শাক-সবজি, দাল, দুধ, এই সবেরই চল বেশি। নিরামিষ খাদ্যের সুলভতা, আর গরম দেশ বলে নিরামিষ খাদ্যের স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগিতা, এই দুই কারণ ছাড়া দেশের জনসাধারণের মধ্যে অহিংসার আদর্শের ব্যাপক আর গভীর প্রসার – এ দেশের নিরামিষ আহারের দিকে আকর্ষণের একটা বড়ো কারণ। আমিষ প্রিয় বহু জাতি ভারতে এসে রুমে নিরামিষের ভক্ত হয়ে পড়েছে। ভারতের আর্যদের কথাও এই - আগে আর্যরা ছিল আমিষ প্রিয়, পরে প্রধানত নিরামিষাশী বা শাকাহারী।

প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষ পশু পক্ষীর মতো খাদ্য সংগ্রহ করে বেড়াত—শিকার করে মাছ ধরে বা কুড়িয়ে বাড়িয়ে বা মাটি খুঁড়ে বা খুঁটে পশু বা পক্ষীর মাংস, মাছ, কচ্ছপ, কাঁকড়া, শামুক, গুগলি কন্দ মূল, পোকা-মাকড় যা পেত সবই খেত। পরে মানুষ পশু পালন শিখলে, ঘর, ধান, গম, বাজরা প্রভৃতির চাষ শিখলে, তখন গৃহপালিত পশুর দুধ আর মাংস, আর চাষের ফল শস্য, বিশেষ করে তার ভোগে এল, মানুষ খাবার সংগ্রহ করার আদিম অবস্থা থেকে খাদ্য প্রস্তুত আর সঞ্চয় করার উন্নত অবস্থায় এসে দাঁড়াল। এই সময়েই দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুসারে বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের মধ্যে খাদ্য বিষয়ে অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেল – পশুপালক অর্ধ-যাযাবর জাতির মানুষ যেমন আদিম আর্যরা ছিল, দুধ আর মাংসের দাস হয়ে পড়ল, আর নানা চাষি জাতির মানুষ, যেমন নিষাদ বা অস্ট্রিক প্রমুখ ভারতের অনার্য, তাদের মধ্যে চাল দাল শাক সবজি (আর যেখানে পাওয়া যেত সেখানে মাছ, আর গৃহপালিত হাঁস মুরগি পায়রা প্রভৃতি পাখির মাংস), এই সবেরই প্রচলন বেশি হলো। গোরু ছাগল ভেড়া ঘোড়া- ভারতের অনার্যদের মধ্যে এই সকল পশুর রেওয়াজ ততটা - ছিল না — চাষের কাজেও মানুষ বলদ-ঘোড়া লাঙ্গলের ব্যবহার তখন করত না, 'জুম' চাষ বা কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে হাতের সাহায্যে চাষ, এই-ই করত। তবে এরা শুভর পুষত, শত্তরের মাংস খেত।

এই রকম নানা পরিবেশের ফলে, সাধারণত আর্যেরা ভারতে আসবার আগেই ভাত, দাল, শাকসবজি, কিছুটা মাছ আর মাংস, এই ছিল প্রাগার্য জাতির মানুষের খাওয়া। আর্যেরা এল পশুপালন দুগ্ধপ্রিয় মাংসাশী জাতির মানুষরূপে। তাদের প্রিয় খাদ্য আগুনের মধ্যে দিয়ে হোম অনুষ্ঠান করে, তাদের উপাস্য দেবতাদের নিবেদন করত। এই খাদ্য ছিল, দম বন্ধ করে অথবা অন্য নিষ্ঠুরভাবে 'আলন্তন করা বা হত্যা করা ছাগল, ভেড়া, গোরু, ঘোড়ার মাংস ও চর্বি, যবের রুটি 'পুরোডাশ', দুধ, ঘী, আর মাদক সোমরস। এই সব জিনিস না হলে, আগুনে ফেলে দেবতাদের জন্য এগুলি নিবেদন না করলে, তাদের উপাসনা হতো না। অনার্যদের পূজার রীতি অন্যধরনের ছিল। আগুনের পাট এতে ছিল না। দেবতার মূর্তি বা প্রতীকের সামনে, নানা প্রকারের কাঁচা শস্য, ফলমূল, আর রান্না করা সুখাদ্য অর্পিত হতো, দেবতার প্রসাদ বলে লোকে তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে খেত। এই সুখাদ্যে কিছু পরিমাণ মাছ মাংস ডিমও দেওয়া হতো (ডিম এখন ভারতের হিন্দু সমাজে যেখানে আর্য বা ব্রাহ্মণ মনোভাব প্রবল সেখানে আর চলে না, কিন্তু নেপালে, ভারতের পূর্ব সীমান্তে আর ভারতের বাইরে ডিমের ব্যবহার দেখা যায়)। পশু বলি হতো, এক কোপে পশুর মাথা কেটে ফেলে, শরায় করে রক্ত নিয়ে দেবতার সামনে রাখা হতো, কোথাও বা সেই রক্ত দেবমূর্তিতে মাখিয়ে দেওয়া হতো। তবে ঠাকুরের ভোগে নিরামিষই, প্রশস্ত ছিল। হোমের অনুষ্ঠানকারী মাংসপ্রিয় আর্য জাতির মানুষ ভারতবর্ষে বসে গেল। অনার্যের প্রভাবের আওতায় এল। দুই জাতির মধ্যে রক্তে ভাষায় সংস্কৃতিতে মিশ্রণ আরম্ভ হলো, অনুলোম আর প্রতিলোম বিবাহের ফলে। মিশ্র হিন্দু জাতির সৃষ্টি হলো। তখন সামিষ আর নিরামিষ আহারের বিভিন্ন আদর্শ ও লোকের চোখের সামনে এসে পড়ল। এই দুইয়েরই সপক্ষে আর বিপক্ষে যুক্তি আর প্রচার চলল। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে এই সামিষ বনাম নিরামিষ প্রসঙ্গের অবতারণা দেখা যায়। মাংসই হচ্ছে সব চেয়ে উপাদেয়, পুষ্টিকর আর জনপ্রিয় খাদ্য, এই মত মহাভারতে স্বীকার করা হয়েছে— এটা মাংসপ্রিয় জাতির তরফের কথা; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও শেষ কথা হিসাবে বলা হয়েছে যে, অহিংসার আদর্শের প্রতি লক্ষ্য রেখে মাংস বর্জন করাই সঙ্গত। অর্থাৎ নিরামিষ ভোজন যে সামিষ ভোজনের চেয়ে দার্শনিক বিচার মতে উচ্চ পর্যায়ের, এই ধারণা

লোকের মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে। ইতিহাসেও তাই দেখা যায়। বৈদিক আর্যের মাংস ভোজন এক দিকে, আর অন্য দিকে হচ্ছে পরবর্তী কালের আর্যমান্য হিন্দু জনসাধারণের মধ্যে মাংসে বিরতি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, এক প্রস্থ শালি বা চাউলের ভাত, তার সিকি পরিমাণ ঘী বা তেল মশলা দিয়ে রাধা সুপ - সম্ভবত দাল—এই হচ্ছে 'আর্যভক্ত', অর্থাৎ আর্য বা উচ্চ শ্রেণির হিন্দুর খাওয়া। অবর বা নিম্নশ্রেণির খাদ্যে দাল আর ঘী বা তেলের অংশটা কিছু কম।

এই দাল-ভাত (কোথাও কোথাও পরবর্তীকালে দাল-রুটি) ভারতের সবচেয়ে লক্ষণীয় খাদা হয়ে দাঁড়ায়। তুর্কি মুসলমানেরা ভারত জয় করে উত্তর ভারতের রাজা হয়ে বসল খ্রিস্টীয় এগারোর শতকে। তারা রাজকার্যে সাহিত্যে ফারসি ভাষা ব্যবহার করত। তারা কি তুর্কি, কি পাঠান বা আফগান, কি ইরানি বা পারসিক স্বদেশে খেত গমের আটার রুটি আর ভেড়ার মাংসের তরকারি — কাবার বা শূলপক্ক মাংস, বা কোর্মা অর্থাৎ ব্যঞ্জন। এদেশে এসে তারা দেখলে, হিন্দুরা মাংস দিয়ে রুটি খায় না, তারা খায় দাল দিয়ে ভাত, শস্য দিয়ে শস্য। তাই অবাক হয়ে ফারসি ভাষায় মন্তব্য করে গেল, 'হিন্দুআন রান্না-বা বা ঘল্লা মি-বৌদন্দ, তা মি-গোয়ন্দ দাল-ভাত? যা 'দাল-রোতি' (— 'হিন্দুরা দানা দিয়ে দানা খায় আর বলে দাল-ভাত বা দালরোটি)। এই দাল-ভাত খাওয়ার ধারা আজ পর্যন্ত সারা ভারতব্যাপী প্রধান খাদ্য ধারারূপে অব্যাহত আছে। জাহাঙ্গির বাদশাহের সময়ে, খ্রিস্টীয় সতেরোর শতকের প্রারম্ভে, ওলন্দাজ পর্যবেক্ষক Pelsaert পেলাসে বলে গিয়েছেন, ভারতের লোকেদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে সিদ্ধ চাল বা ভাত, তার সঙ্গে দাল, আর তার উপর এক খামচা ঘী।

ভারতে হিন্দু আমলে যে মাংস রাঁধার পদ্ধতি ছিল, তার বিশেষ বর্ণনা পাওয়া যায় না। মাংসে মশলা ব্যবহারের কথা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আছে। 'নল-পাক' অর্থাৎ নলরাজার নামে প্রচলিত রন্ধন বিষয়ে যে সংস্কৃত বই প্রচলিত, তাতে অনেক রকমের ভাতের কথা আছে, শাক তরকারি মাংসের কথা কম। পুরাতন বাঙলা সাহিত্যের বইয়ে রহনের বর্ণনা আর নানা প্রকারের ব্যঞ্জনের নাম থেকে আমরা খ্রিস্টীয় পাদশ শতক থেকে, চৈতন্যদেবের সময় থেকে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, বাঙালির আমিষ আর নিরামিষ খাদ্যের একটা পরিচয় পাই। তেমনি হিন্দি আর উত্তর ভারতে লেখা সংস্কৃত বই থেকে উত্তর ভারতের 'কঙ্গী' অর্থাৎ কাঁচা ভোজা - দাল, ভাত, শাক, তরকারি আর 'পঞ্চী' অর্থাৎ ঘৃতপক্ক উচ্চ শ্রেণির ভোজপুরি, কটৌরি, লাড্ডু, মিঠাই, পেঁড়া প্রভৃতির বর্ণনা পাই। খাবারের নাম থেকে তার প্রাচীনতা ধরা যায়। লাড়ু, পেঁড়া, খাজা, পূয়া বা মালপোয়া, বুঁদিয়া এই মিষ্টান্নগুলি মুসলমান-পূর্ব যুগের। মোহনভোগ নামটা প্রাচীন—এটির কথা সংস্কৃত বইয়ে পাওয়া যায়, ভারতের কোথাও কোথাও এই নাম প্রচলিত আছে, কিন্তু আরবি হালুয়া এই শব্দকে অপ্রলিত করে দিয়েছে। গজা, বালুকাশাহি, জিলেবি, বরফি, কালাকন্দ — এগুলি পারস্য দেশ থেকে এসেছে। 'গঙ্গা' নামটির মূলরূপ শুনলে অনেক নিষ্ঠাবান হিন্দু এই জনপ্রিয় মিষ্টান্নটি আর খেতে চাইবেন না। — ফারসি “গও জবান অর্থাৎ গোজিহ্বা। তা থেকে “গও-জআঁ, গওজা, গজা” – নামের এখন এমন পরিবর্তন হয়েছে যে মূল গজার রূপ বর্ণনের জন্য আমরা এর ব্যাখ্যা করে বলি— জিভেজা'।

ভারতবর্ষের মিষ্টান্ন খুবই বিখ্যাত কিছু মিষ্টান্ন বিষয়ে মুসলমান জগৎ আর ইরানি জগৎ, আর ভারতবর্ষ, প্রায় একই পর্যায়ে পড়ে। আমাদের ভারতীয় মিষ্টান্ন দুই প্রকারের এক দুধ জমিয়ে আর দুধ ফাটিয়ে, ক্ষীর আর ছানার আধারে তৈরি মিষ্টান্ন, যেমন পেঁড়া, বরফি, কালাবন্দ, গোলাপজাম, রাবড়ি; আর সন্দেশ, রসগোলা, ছানাবড়া, ছানার মুড়কি, চমচম। দুধ ফুটিয়ে ছানা করে তার মিষ্টান্ন বাংলা দেশের বৈশিষ্ট্য ভারতের অন্যত্র ছানার রেওয়াজ নেই। বাংলার রসগোল্লা এখন নিজগুণে 'বঙ্গাল-মিঠাই' নামে সমগ্র ভারতের এক অতি বিখ্যাত মিষ্টান্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে—বহুস্থানে উচ্চাঙ্গের ভোজে রসগোল্লা থাকতেই হবে। দ্বিতীয় প্রকার মিষ্টান হচ্ছে শস্য-চূর্ণের আধারে যবের ছাতু, গমের আটা, চালের গুঁড়া, দালের গুঁড়া প্রভৃতি দিয়ে বা তেলে ভেজে নুন বা চিনি বা চিনির রস মিশিয়ে তৈরি নোনতা বা মিষ্টি পঞ্চান্ন। এর উপরে আবার নারকোল কুচি বা কোরা, পেস্তা বাদাম কিশমিশ প্রভৃতি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। ইউরোপের মিষ্টান্নে Cakes and Pastry-তে ডিম থাকা চাইই – ভারতীয় মিষ্টান্নে ডিম থাকে না, ধর্মের দিক দিয়ে ডিম বারণ। হালুয়া দক্ষিণ ভারতের উপমা, লুচি, সিঙ্গাড়া (বা সম্বোসা ধোসা, নানা রকমের বড়া আর বড়ি ভাজা আর ফুলুরি প্রভৃতি এই পর্যায়ে আসে।

খাঁটি ভারতীয় রান্নায় আবার প্রাদেশিক বৈশিষ্ট্য আছে। উত্তর ভারতের দাল, ভাজা, শাক প্রভৃতিতে যেভাবে 'বঘার' বা ফোড়ন দেওয়া হয়, তা আমাদের দেশের ফোড়ন থেকে বা সাঁতলানো থেকে আলাদা। আবার ভাতে সিদ্ধ করে তরকারির তার বদলানো হয়। দই, তেঁতুল, আমচুর, লঙ্কা, মরিচা, গরমমশলা, কোথাও বা ভাজা মশলা, নারকোল এসব ভারতীয় রান্নার অন্যতম প্রধান উপকরণ চীনা বা ইউরোপীয় অথবা আরব-ইরান রান্নায় এসবের পার্ট তেমন নেই। ভারতের গ্রামীয় বা প্রাদেশিক রান্নার কথা নিয়ে বড়ো একখানি বই লেখা যায়। সুখের বিষয়, বাংলার নিজস্ব রান্নার সম্বন্ধে (খাঁটি বাঙালি রান্না, আর যেসব জিনিস বাঙালির হেঁসেলে স্থান পেয়েছে সেইসব বিদেশি রান্না,

এই দুইয়ের সম্বন্ধে) স্বর্গীয় বিপ্রদাস মুখুজ্জে মহাশয়ের বিখ্যাত বই 'পাক প্রণালী' গৌরবের সঙ্গে উল্লেখ করবার। মুসলমানি অর্থাৎ ইরানি-ভারতীয় (বা মোগলাই) রান্না, ভারতের রান্নারই মধ্যে পড়ে। পোর্তুগিস, ফরাসি, এদের কাছ থেকে আর ইংরেজদের কাছ থেকেও অনেক কিছু আমরা নিয়েছি বিশেষ মাংস পাকে। ডাচদের Poespas হয়েছে আমাদের 'পিসপাস- ভাতে মাংসে পাক করা ঘৃতমিশ্র মশলা কেসর দেওয়া পোলাও নয়। ইংরিজি 'চপ কাটলেট' নামগুলি নিয়েছি, কিন্তু পদ্ধতিটা আমরা পোর্তুগিসনের কাছ থেকে শিখেছি। —ইংরিজি, চপ কাটলেটে মাংসকে কিমা করে রাঁধা হয় না, হাড়শুদ্ধ পাঁজরার মাংসই এতে ব্যবহার করা হয়। ইন্দো-পোর্তুগিস যা গোয়ায় আর চাট গাঁয়ে প্রচলিত, আর অ্যাংগ্রো-ইন্ডিয়ান রান্না, যা সারা ভারত জুড়ে ইংরেজ আর ফিরিঙ্গির ইউরোপীয় হোটেল রেস্তোরাঁর বাবুর্চিখানায় প্রচলিত, এদুটিকেও ভারতীয় রান্নার মধ্যে গণ্য করতে হয়।

ভারতবর্ষে কোথাও কোথাও সাত-আট শো, হয়তো হাজার দেড় হাজার বছর ধরে প্রাচীন রন্ধন পদ্ধতি অপরিবর্তিত অবস্থায় পাওয়া যায়। যেমন পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে যে ভোগ দেওয়া হয়— খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের উড়িষ্যার শ্রেষ্ঠ নিরামিষ রান্নার এই নিদর্শন এই কয়েক শত বৎসর ধরে অপরিবর্তিত রূপে চলে এসেছে। তেমনি দক্ষিণ ভারতের অনেক মন্দিরের ভোগের সম্বন্ধেও একথা বলা যায়। এইগুলির বিশেষ আলোচনার মধ্যে ভারতবর্ষের রন্ধন-শিল্পের ইতিহাসের কথা নিহিত আছে। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরিতে আকবর বাদশার রন্ধনশালার ত্রিশ রকম খাদ্যের উপাদান দেওয়া আছে – দশ রকম শুদ্ধ নিরামিষ, দশ রকম মিশ্র আমিষ নিরামিষ, আর দশ রকম শুদ্ধ আমিষ। দশসের ঘি, দশসের মিসরি, দশসের সুজি, আর অন্য উপকরণ সম্ভবত এইভাবে এই ইচ্ছে বাদশাহি হালুয়ার উপাদানের প্রমাণ।

মোট কথা ভারতবর্ষের লোক যা খায়, তার একটা আলোচনা নানাদিক দিয়ে কৌতুকপ্রদ, শিক্ষাপ্রদ। পার্থক্য নানা রকমের আছে। কিন্তু তবুও একটা সাধারণ ভারতীয়তা আছে। বিদেশ - লন্ডনে, প্যারিসে, নিউ ইয়র্কে যেসব ভারতীয় ভোজনশালা আছে, সেইগুলির মাধ্যমে ভোজন বিষয়ে যে সাধারণ ভারতীয়তার বৈশিষ্ট্য ধরে দেওয়া হচ্ছে তা স্বীকার করতেই হয়। ভারতীয় ভোজনশালায় এই জিনিসগুলি থাকবেই— ভাত, দাল, নিরামিষ বা মাংস বা মাছের রকমারি তরকারি, পোলাও, হালুয়া ভাজি, পকোড়া, চাটনি, দই, 'রসগুল্লা', 'গোলাব জামুন', পাঁপড়। এই পাঁপড় একটি নিখিল ভারতীয় বস্তু। শব্দটি সংস্কৃত 'পপট' রূপে পাওয়া যায়—এটি ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে কেউ কেউ মনে করেন। 'পর্পট' থেকে 'পপ্পড-পপ্পড়', তাহাতে পাঁপড়, পপ্পড়, পাঁপর, পপডম ইত্যাদি আধুনিক রূপ। কিন্তু মনে হয় এই দালের পিষ্ট থেকে তৈরি এই জনপ্রিয় ভারতীয় খাদ্যবস্তু মূলে দ্রাবিড় জাতির দান তুলনীয়, তামিলে দাল অর্থে 'পপ্পু' শব্দ ভারতীয় আহারের অনেকখানি অংশই প্রাগার্য যুগের খাদ্যবস্তু আর রন্ধন রীতির আধারে গঠিত এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

লেখকের পরিচিত :-

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭) : ভাষাতাত্ত্বিক, বহুভাষাবিদ এবং জাতীয় অধ্যাপক। ভস্ম হাওড়ার শিবপুরে। তিনি 'The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থ রচনার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে – 'দ্বীপময় ভারতশ্যামদেশ", "ইউরোপ ভ্রমণ', 'সাংস্কৃতিকী' প্রভৃতি। তাঁর আত্মজীবনী 'জীবনকথা' একটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য গ্রন্থ। 'পথ-চলতি' তার বিশ্বপরিভ্রমণের ইতিকথা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনাদের কোন প্রশ্ন থাকলে দয়া করে জানাবেন ।