" ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত "
ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত বাংলা গল্প
![]() |
ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক |
"লেখক :-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়"
"লেখকের পরিচিত" :-
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ – ১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮) ছিলেন একজন বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক, ও গল্পকার। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় এবং বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তার অনেক উপন্যাস ভারতবর্ষের প্রধান ভাষাগুলোতে অনূদিত হয়েছে। বড়দিদি (১৯১৩), পরিণীতা (১৯১৪), পল্লীসমাজ (১৯১৬), দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), শ্রীকান্ত (চারখণ্ডে ১৯১৭-১৯৩৩), দত্তা (১৯১৮), গৃহদাহ (১৯২০), পথের দাবী (১৯২৬), শেষ প্রশ্ন (১৯৩১) ইত্যাদি শরৎচন্দ্র রচিত বিখ্যাত উপন্যাস।[২] বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার দরুন তিনি 'অপরাজেয় কথাশিল্পী' নামে খ্যাত। লেখকের সম্বন্ধে আরো পড়ুন।
ইন্দ্র আমার দিকে চাহিয়া কহিল, তুই বুঝি এই বাড়িতে থাকিস শ্রীকান্ত?
আমি কহিলাম, হ্যাঁ। তুমি এত রাত্তিরে কোথায় যাচ্ছ?
ইন্দ্র হাসিয়া কহিল, রাত্তির কোথায় রে, এই ত সন্ধ্যা। আমি যাচ্ছি আমার ডিঙিতে মাছ ধরে আনতে। যাবি?
আমি সভয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম, এত অন্ধকারে ভিত্তিতে চড়বে?
সে আবার হাসিল। কহিল, ভয় কী রে! সেই তো মজা। তা ছাড়া অন্ধকার না হ'লে কি মাছ পাওয়া যায়? সাঁতার জানিস?
খুব জানি।
তবে আয় ভাই! বলিয়া সে আমার একটা হাত ধরিল। কহিল, আমি একলা এত স্রোতে উজোন বাইতে পারিনে একজন কাউকে খুঁজি, যে ভয় পায় না।
আমি আর কথা কহিলাম না। তাহার হাত ধরিয়া নিঃশব্দে রাস্তার উপর আসিয়া উপস্থিত হইলাম। প্রথমটা আমার নিজেরই যেন বিশ্বাস হইল না- আমি সত্যিই এই রাতে নৌকায় চলিয়াছি। কারণ, যে আহ্বানে এই স্তব্ধ-নিবিড় নিশীথে এই বাড়ির সমস্ত কঠিন শাসনপাশ তুচ্ছ করিয়া দিয়া, একাকী বাহির হইয়া আসিয়াছি, সে যে কত বড়ো আকর্ষণ, তাহা তখন বিচার করিয়া দেখিবার আমার সাধ্য ছিল না। অনতিকাল পরে গোঁসাইবাগানের সেই ভয়ঙ্কর বনপথের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম এবং ইন্দ্রকে অনুসরণ করিয়া স্বপ্নাবিষ্টের মতো তাহা অতিক্রম করিয়া গঙ্গার তীরে আসিয়া দাঁড়াইলাম। খাঁড়া কাঁকরের পাড়। মাথার উপর একটা বহু প্রাচীন অশ্বত্থবৃক্ষ মূর্তিমান অন্ধকারের মতো নীরবে দাঁড়াইয়া আছে এবং তাহার প্রায় ত্রিশ হাত নীচে সূচিভেদ্য আঁধারতলে পরিপূর্ণ বর্ষার গভীর জলস্রোত ধাক্কা খাইয়া
আবর্ত রচিয়া উদ্দাম হইয়া ছুটিয়াছে। দেখিলাম, সেইখানে ইন্দ্রের ক্ষুদ্র তরীখানি বাঁধা আছে। উপর হইতে মনে
হইল, সেই সুতীব্র জলধারার মুখে একখানি ছোট্ট মোচার খোলা যেন নিরন্তর কেবলই আছাড় খাইয়া মরিতেছে।
আমি নিজেও নিতান্ত ভীরু ছিলাম না। কিন্তু ইন্দ্ৰ যখন উপর হইতে নীচে একগাছি রজ্জু দেখাইয়া কহিল, ডিঙির এই দড়ি ধ'রে পা টিপে টিপে নেবে যা, সাবধানে নাবিস, পিছলে পড়ে গেলে আর তোকে খুঁজে পাওয়া যাবে না; তখন যথার্থই আমার বুক কাঁপিয়া উঠিল। মনে হইল, ইহা অসম্ভব। কিন্তু তথাপি আমার তো দড়ি অবলম্বন আছে, কিন্তু তুমি?
সে কহিল, তুই নেবে গেলেই আমি দড়ি খুলে দিয়ে না। ভয় নেই আমার নেবে যাবার অনেক ঘাসের শিকড় ঝুলে আছে।
আর কথা না কহিয়া আমি দড়িতে ভর দিয়া অনেক যত্নে অনেক দুঃখে নীচে আসিয়া নৌকায় বসিলাম। তখন দড়ি খুলিয়া দিয়া ইন্দ্ৰ ঝুলিয়া পড়িল। সে যে কী অবলম্বন করিয়া নামিতে লাগিল, তাহা আজও আমি জানি না। ভয়ে বুকের ভিতরটা এমনি টিপটিপ করিতে লাগিল যে, তাহার পানে চাহিতে পারিলাম না। মিনিট দুই-তিন কাল বিপুল জলধারার মত্তগর্জন ছাড়া কোনো শব্দমাত্র নাই। হঠাৎ ছোট্ট একটুখানি হাসির শব্দে চকিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া দেখি, ইন্দ্র দুই হাত দিয়া নৌকা সজোরে ঠেলিয়া দিয়া লাফাইয়া চড়িয়া বসিল। ক্ষুদ্র তরী তীব্র একটা পাক খাইয়া নক্ষত্রবেগে ভাসিয়া চলিয়া গেল।
কয়েক মুহূর্তেই ঘনান্ধকারে সম্মুখ এবং পশ্চাৎ লেপিয়া একাকার হইয়া গেল। রহিল শুধু দক্ষিণ ও বামে সীমান্তরাল প্রসারিত বিপুল উদ্দাম জলস্রোত এবং তাহারই উপর তীব্রগতিশীলা এই ক্ষুদ্র তরণীটি এবং কিশোরবয়স্ক দুটি বালক। প্রকৃতিদেবীর সেই অপরিমেয় গম্ভীর রূপ উপলব্ধি করিবার বয়স তাহাদের নহে, কিন্তু সে কথা আমি আজও ভুলিতে পারি নাই। বায়ুলেশহীন, নিষ্কম্প, নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ নিশীথিনীর সে যেন এক বিরাট কালীমূর্তি। নিবিড় কালো চুলে দ্যুলোক ও ভুলোক আচ্ছন্ন হইয়া গেছে, এবং সেই সূচিভেদ্য অন্ধকার বিদীর্ণ করিয়া করাল দংষ্ট্রারেখার ন্যায় দিগন্তবিস্তৃত এই তীব্র জলধারা হইতে কী এক প্রকারের অপরূপ স্তিমিত দ্যুতি নিষ্ঠুর চাপা হাসির মত বিচ্ছুরিত হইতেছে। আশেপাশে সম্মুখে কোথাও বা উন্মত্ত জলস্রোত গভীর তলদেশে ঘা খাইয়া উপরে ফাটিয়া পড়িতেছে, কোথাও বা প্রতিকূল গতি পরস্পরের সংঘাতে আবর্ত রচিয়া পাক খাইতেছে, কোথাও বা অপ্রতিহত জলপ্রবাহ পাগল হইয়া ধাইয়া চলিয়াছে।
আমাদের নৌকা কোনাকুনি পাড়ি দিতেছে, এইমাত্র বুঝিয়াছি। কিন্তু পরপারের ওই দুর্ভেদ্য অন্ধকারের কোনখানে যে লক্ষ্য স্থির করিয়া ইন্দ্র হাল ধরিয়া নিঃশব্দে বসিয়া আছে তাহার কিছুই জানি না। এই বয়সেই সে যে কত বড়ো পাকা মাঝি, তখন তাহা বুঝি নাই। হঠাৎ সে কথা কহিল, কী রে শ্রীকান্ত, ভয় করে ?
আমি বললাম, নাঃ
ইন্দ্ৰ খুশি হইয়া কহিল, এই ত চাই-সাঁতার জানলে আবার ভয় কীসের! প্রত্যুত্তরে আমি একটি ছোট্ট নিশ্বাস চাপিয়া ফেলিলাম- পাছে সে শুনিতে পায়। কিন্তু এই গাঢ় অন্ধকার রাত্রিতে, এই জলরাশি এবং এদুর্জয় স্রোতের সঙ্গে সাঁতার জানা, এবং না-জানার পার্থক্য যে কী, তাহা ভাবিয়া পাইলাম না। সেও আর কোনো কথা কহিল না। বহুক্ষণ এইভাবে চলার পরে কী একটা যেন শোনা গেল-অস্ফুট এবং ক্ষীণ; কিন্তু নৌকা যত অগ্রসর হইতে লাগিল, ততই সে শব্দ স্পষ্ট এবং প্রবল হইতে লাগিল। যেন বহুদূরাগত কাহাদের রুদ্ধ আহ্বান। যেন কত বাধাবিঘ্ন ঠেলিয়া ডিঙাইয়া সে আহ্বান আমাদের কানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে-এমনি শান্ত, অথচ বিরাম নাই, বিচ্ছেদ নাই-ক্রোধ যেন তাহাদের কমেও না, বাড়েও না, থামিতেও চাহে না। মাঝে মাঝে এক-একবার ঝুপঝাপ শব্দ। জিজ্ঞাসা করিলাম, ইন্দ্র ও কীসের আওয়াজ শোনা যায়? সে নৌকার মুখটা আর একটু সোজা করিয়া দিয়া কহিল, জলের স্রোতে ওপারের বালির পাড় ভাঙার শব্দ।
জিজ্ঞাসা করিলাম, কত বড় পাড়? কেমন স্রোত ?
সে ভয়ানক স্রোত। ওঃ, তাইত, কালো জল হয়ে গেছে, আজ তো তার তলা দিয়ে যাওয়া যাবে না। একটা পাড় ভেঙে পড়লে ডিঙিসুদ্ধ আমরা সব গুঁড়িয়ে যাব। তুই দাঁড় টানতে পারিস? পারি। তবে টান
আমি টানিতে শুরু করিলাম। ইন্দ্র কহিল, উই—উই যে কালো মতো বাঁদিকে দেখা যায় ওটা চড়া। ওরি মধ্যে দিয়ে একটা খালের মতো আছে, তারি ভিতর দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে, কিন্তু খুব আস্তে জেলেরা টের পেলে আর ফিরে আসতে হবে না। লগির ঘায়ে মাথা ফাটিয়ে পাঁকে পুঁতে দেবে।
এ আবার কী কথা! সভয়ে বলিলাম, তবে ওর ভিতর দিয়ে নাই গেলে! ইন্দ্র বোধ করি একটু হাসিয়া
কহিল, আর তো পথ নেই। এর মধ্যে দিয়ে যেতেই হবে। বড়ো চড়ার বাঁদিকের রেত ঠেলে জাহাজ যেতে পারে
না- আমরা যাব কী ক'রে? ফিরে আসতে পারা যাবে, কিন্তু যাওয়া যাবে না।
তবে মাছ চুরি ক'রে কাজ নেই ভাই, বলিয়া আমি দাঁড় তুলিয়া ফেলিলাম। চক্ষের পলকে নৌকা পাক খাইয়া পিছাইয়া গেল। ইন্দ্র বিরক্ত হইয়া ফিশফিশ করিয়া তর্জন করিয়া উঠিল—তবে এলি কেন? চল তোকে ফিরে রেখে আসি-কাপুরুষ! তখন চোদ্দো পার হইয়া পনেরোয় পরিয়াছি-আমাকে কাপুরুষ ? ঝপাৎ করিয়া দাঁড় জলে ফেলিয়া প্রাণপণে টান দিলাম। ইন্দ্ৰ খুশি হইয়া বলিল, এই তো চাই। কিন্তু আস্তে ভাই—ব্যাটারা ভারী পাজি। আমি ঝাউবনের পাশ দিয়ে মক্কাখেতের ভিতর দিয়ে এমনি বার করে নিয়ে যাব যে শালারা টেরও পাবে না। একটু হাসিয়া কহিল, আর টের পেলেই বা কী ? ধরা কি মুখের কথা দেখ শ্রীকান্ত, কিচ্ছু ভয় নেই-ব্যাটাদের চারখানা ডিঙি আছে বটে, কিন্তু যদি দেখিস ঘিরে ফেললে বলে- আর পালাবার জো নেই, তখন ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ে এক ডুবে যতদূর পারিস ভেসে উঠলেই হলো। এ অন্ধকারে আর দেখবার জো-টি নাই, তারপর মজা করে সতুয়ার চড়ায় উঠে ভোরবেলায় সাঁতরে এপারে এসে গঙ্গার ধার ধরে বাড়ি ফিরে গেলেই বাস্! কী করবে ব্যাটারা ?
চড়াটার নাম শুনিয়াছিলাম; কহিলাম, সতুয়ার চড়া তো ঘোরনালার সমুখে, সে তো অনেক দূর।
ইন্দ্র তাচ্ছিল্যভরে কহিল, কোথায় অনেক দুর? ছ-সাত কোশও হবে না বোধহয়। হাত ভেরে গেলে চিত
হ'য়ে থাকলেই হ'লতা ছাড়া মড়া-পোড়ানো বড়ো বড়ো গুঁড়ি কত ভেসে যাবে দেখতে পাবি। আত্মরক্ষার যে সোজা রাস্তা সে দেখাইয়া দিল, তাহাতে প্রতিবাদের আর কিছু রহিল না। এই দিক চিহ্নহীন অন্ধকার নিশীথে আবর্তসংকুল গভীর তীব্র জলপ্রবাহে সাত ক্লোশ ভাসিয়া গিয়া ভোরের জন্য প্রতীক্ষাই করিয়া থাকা। ইহার মধ্যে আর এদিকের তীরে উঠিবার জো নাই। দশ-পনের হাত খাড়া বালির পাড় মাথায় ভাঙিয়া পড়িবে— এই দিকেই গঙ্গার ভীষণ ভাঙন ধরিয়া জলস্রোেত অর্ধবৃত্তাকারে ছুটিয়া চলিয়াছে। বস্তুটা অস্পষ্ট উপলব্ধি করিয়াই আমার বীরহৃদয় সংকুচিত হইয়া বিন্দুবৎ হইয়া গিয়াছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়
টানিয়া বলিলাম, কিন্তু আমাদের ডিঙির কী হবে? ইন্দ্ৰ কহিল, সেদিন তো আমি ঠিক এমনি করেই পালিয়েছিলাম। তার পরদিন এসে ডিঙি কেড়ে নিয়ে গেলাম, বললাম, নৌকা ঘাট থেকে চুরি করে আর কেউ এনেছিল-আমি নয়।
তবে এ-সকল এর কল্পনা নয়—একেবার হাতেনাতে প্রত্যক্ষ করা সত্য! ক্রমশ ডিঙি খাঁড়ির সম্মুখীন হইলে দেখা গেল, জেলেদের নৌকাগুলি সারি দিয়ে খাঁড়ির মুখে বাঁধা আছে- মিটমিট করিয়া আলো জ্বলিতেছে। দুইটি চড়ার মধ্যবর্তী এই জলপ্রবাহটা খালের মত হইয়া প্রবাহিত হইতেছিল। ঘুরিয়া তাহার অপর পাড়ে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সে স্থানটায় জলের বেগে অনেকগুলি মোহনার মতো হইয়াছে এবং সব কয়টাকেই বুনো ঝাউগাছে একটা হইতে আর একটাকে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে। একটার ভিতর দিয়া খানিকটা বাহিয়া গিয়াই আমরা খালের মধ্যে পড়িলাম। জেলেদের নৌকাগুলো তখন অনেকটা দূরে কালো কালো ঝোপের মতো দেখাইতেছে। আরও খানিকটা অগ্রসর হইয়া গন্তব্যস্থানে পৌঁছানো গেল।
ধীবর প্রভুরা খালের সিংহদ্বার আগুলিয়া আছে মনে করিয়া এ স্থানটায় পাহারা রাখে নাই। ইহাকে মায়াজাল বলে। খালে যখন জল থাকে না তখন এধার হইতে ওধার পর্যন্ত উঁচু উঁচু কাঠি শক্ত করিয়া পুঁতিয়া দিয়া তাহারই বহির্দিকে জাল টাঙাইয়া রাখে। পরে বর্ষার জলস্রোতে বড়ো বড়ো রুই-কাতলা ভাসিয়া আসিয়া এই কাঠিতে বাধা পাইয়া লাফাইয়া ওদিকে পড়িতে চায় এবং দড়ির জাল আবদ্ধ হইয়া থাকে।
দশ, পনেরো, বিশ সের রুই-কাতলা গোটা পাঁচ-ছয় ইন্দ্র চক্ষের নিমেষে নৌকায় তুলিয়া ফেলিল। সেই বিরাটাকার মৎস্যরাজেরা তখন পুচ্ছতাড়নায় ক্ষুদ্র ডিঙিখানা যেন চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া দিবার উপক্রম করিতে লাগিল, এবং তাহার শব্দও বড়ো কম হইল না।
এত মাছ কী হবে ভাই?
কাজ আছে। আর না, পালাই চল। বলিয়া সে জাল ছাড়িয়া দিল। আর দাঁড় টানিবার প্রয়োজন নাই। আমি চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। তখন তেমনি গোপনে আবার সেই পথেই বাহির হইতে হইবে। অনুকুল স্রোতে মিনিট দুই-তিন খরবেগে ভাটাইয়া আসিয়া হঠাৎ একস্থানে একটা দমকা মারিয়া যেন আমাদের এই ক্ষুদ্র ডিঙিটি পাশের ভুট্টা খেতের মধ্যে গিয়া প্রবেশ করিল। তাহার এই আকস্মিক গতিপরিবর্তনে আমি চকিত হইয়া প্রশ্ন করিলাম, কী? কী হ'ল ?
ইন্দ্র আর একটা ঠেলা দিয়া নৌকাখানা আরও খানিকটা ভিতরে পাঠাইয়া দিয়া কহিল, চুপ! শালারা টের পেয়েছে-চারখানা ভিত্তি খুলে দিয়েই এদিক আসচে ওই দ্যাখ! তাই তো বটে ! প্রবল জল -তাড়নায় ছপাছপ শব্দ করিয়া চারখানা নৌকা আমাদের গিলিয়া ফেলিবার
জন্য যেন কৃষ্ণকায় দৈত্যের মতো ছুটিয়া আসিতেছে। ওদিকে জাল দিয়া বন্ধ, সুমুখে ইহারা। পলাইয়া নিষ্কৃতি পাইবার এতটুকু স্থান নাই। এই ভুট্টা খেতের মধ্যেই যে আত্মগোপন করা চলিবে, তাহাও সম্ভব মনে হইল না। কী হবে ভাই? বলিতে বলিতেই অদম্য বাষ্পোচ্ছ্বাসে আমার কণ্ঠনালি রুদ্ধ হইয়া গেল। এই অন্ধকারে এই ফাঁদের মধ্যে খুন করিয়া এই খেতের মধ্যে পুঁতিয়া ফেলিলেই বা কে নিবারণ করিবে?
ইতিপূর্বে পাঁচ-ছয় দিন ইন্দ্র 'চুরি বিদ্যা বড়ো বিদ্যা' সপ্রমাণ করিয়া নির্বিঘ্নে প্রস্থান করিয়াছে, এতদিন ধরা পড়িয়াও পড়ে নাই, কিন্তু আজ?
সে মুখে একবার বলিল ভয় নেই। কিন্তু গলাটা তাহার যেন কাঁপিয়া গেল। কিন্তু সে থামিল না। প্রাণপণে লগি ঠেলিয়া ক্রমাগত ভিতরে লুকাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। সমস্ত চড়াটা জলে জলময়। তাহার উপর আট-দশ হাত দীর্ঘ ভুট্টা এবং জনারের গাছ। ভিতরে এই দুটি চোর। কোথাও জল এক বুক, কোথাও এক কোমর, কোথাও হাঁটুর অধিক নয়। উপরে নিবিড় অন্ধকার, সম্মুখে পশ্চাতে দক্ষিণে বামে দুর্ভেদ্য জঙ্গল, পাঁকে লগি পুঁতিয়া যাইতে লাগিল, নৌকা আর একহাতও অগ্রসর হয় না। পিছন হইতে জেলেদের অস্পষ্ট কথাবার্তা কানে আসিতে লাগিল। কিছু একটা সন্দেহ করিয়াই যে তাহারা আসিয়াছে এবং তখনও খুঁজিয়া ফিরিতেছে, তাহাতে লেশমাত্র সন্দেহ নাই।
সহসা নৌকাটা একটু কাত হইয়া সোজা হইল। চাহিয়া দেখি, আমি একাকী বসিয়া আছি, দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই। সভায় ডাকিলাম, ইন্দ্র? হাত পাঁচ-ছয় দূরে বনের মধ্যে হইতে সাড়া আসিল, আমি নীচে।
নীচে কেন?
ডিঙি টেনে বের করতে হবে। আমার কোমরে দড়ি বাঁধা আছে।
টেনে কোথায় বার করবে?
ও গঙ্গায়। খানিকটা যেতে পারলেই বড়ো গাঙে পড়ব।
শুনিয়া চুপ করিয়া গেলাম। ক্রমশ ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। অকস্মাৎ কিছুদুরে বনের মধ্যে ক্যানেস্ত্রা পিটানো ও চেরা বাঁশের কটাকট শব্দে চমকাইয়া উঠিলাম। সভয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম, ও কী রে ভাই? সে উত্তর দিল, চাষিরা মাচার উপর বসে বুনো শুয়ার তাড়াচ্ছে।
বুনো শুয়ার। কোথায় সে? ইন্দ্ৰ নৌকা টানিতে টানিতে তাচ্ছিল্যভরে কহিল, আমি কি দেখতে পাচ্ছি যে বলব? আছেই কোথাও এইখানে। জবাব শুনিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিলাম। ভাবিলাম, কার মুখ দেখিয়া আজ প্রভাত হইয়াছিল। সন্ধ্যারাত্রে আজই ঘরের মধ্যে বাঘের হাতে পড়িয়াছিলাম। এ জঙ্গলে যে বুনো শুয়ারের হাত পড়িব, তাহাতে আর বিচিত্র কী? তথাপি আমি তো নৌকায় বসিয়া; কিন্তু ওই লোকটি একবুক কাদা ও জলের মধ্যে এই বনের ভিতরে। এক পা নড়িবাব চড়িবার উপায় পর্যন্ত তাহার নাই। মিনিট পনেরো এইভাবে কাটিল। আর একটা জিনিস লক্ষ করিতেছিলাম। প্রায় দেখিতেছি, কাছাকাছি এক-একটা জনার, ভুট্টাগাছের ডগা ভয়ানক আন্দোলিত হইয়া ‘ছপাৎ করিয়া শব্দ হইতেছে। একটা প্রায় আমার হাতের কাছেই। সশঙ্কিত হইয়া সেদিকে ইন্দ্রের মনোযোগ আকৃষ্ট করিলাম। ধাড়ি শুয়ার না হইলেও বাচ্চা-টাচ্চা নয় তো?
ইন্দ্ৰ অত্যন্ত সহজভাবে কহিল, ও কিছু না- সাপ জড়িয়ে আছে; তাড়া পেয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিছু না-সাপ। শিহরিয়া নৌকার মাঝখানে জড়োসড়ো হইয়া বসিলাম। অস্ফুটে কহিলাম, কী সাপ ভাই? ইন্দ্র কহিল, সব রকম আছে, টোড়া, বোড়া, গোখরো, করেত জলে ভেসে এসে গাছে জড়িয়ে আছে-কোথাও ডাঙা নেই দেখচিস নে সে তো দেখচি।
কিন্তু ভয়ে যে পায়ের নখ হইতে মাথার চুল পর্যন্ত আমার কাঁটা দিয়া রহিল। সে লোকটি কিন্তু ভ্রুক্ষেপমাত্র করিল না, নিজের কাজ করিতে করিতে বলিতে লাগিল, কিন্তু কামড়ায় না। ওরা নিজেরাই ভয়ে মরচে—দুটো-তিনটে ত আমার গা ঘেঁষে পালালো। এক-একটা মস্ত বড়ো—সেগুলো বোড়া টোড়া হবে।
বোধহয়। আর কামড়ালেই বা কী করব। মরতে একদিন তো হবেই ভাই। এমনি আরও কত কী সে মৃদু স্বাভাবিক কণ্ঠে বলিতে বলিতে চলিল, আমার কানে কতক পৌঁছিল কতক পৌঁছিল না। আমি নির্বাক-নিস্পন্দ কাঠের মতো আড়ষ্ট হইয়া একস্থানে একভাবে বসিয়া রহিলাম। নিশ্বাস ফেলিতেও যেন ভয় করিতে লাগিল-ছপাৎ করিয়া একটা যদি নৌকার উপরেই পড়ে।
কিন্তু সে যাই হোক, ওই লোকটি কী । দেবতা? পিশাচ? কে ও? কার সঙ্গে এই বনের মধ্যে ঘুরিতেছি? যদি মানুষই হয়, তবে ভয় বলিয়া কোনো বস্তু যে বিশ্বসংসারে আছে, সে কথা কি ও জানেও না। বুকখানা কি পাথর দিয়া তৈরি? সেটা কি আমাদের মত সংকুচিত বিস্ফারিত হয় না? তবে যে সেদিন মাঠের মধ্যে সকলে পলাইয়া গেলে, সে নিতান্ত অপরিচিত আমাকে একাকী নির্বিঘ্নে বাহির করিবার জন্য শত্রুর মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল, সে দয়ামায়াও কি ওই পাথরের মধ্যেই নিহিত ছিল। আর আজ? সমস্ত বিপদের বার্তা তন্নতন্ন করিয়া জানিয়া শুনিয়া নিঃশব্দে অকুণ্ঠিতচিত্তে এই ভয়াবহ, অতি ভীষণ মৃত্যুর মুখে নামিয়া দাঁড়াইল, একবার একটা মুখের অনুরোধও করিল না-“শ্রীকান্ত, তুই একবার নেমে যা। সে তো জোর করিয়াই আমাকে নামাইয়া দিয়া নৌকা টানাইতে পারিত। এ তো শুধু খেলা নয়। জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াইয়া এই স্বার্থত্যাগ এই বয়সে কয়টা লোক করিয়াছে। ওই যে বিনা আড়ম্বরে সামান্যভাবে বলিয়াছিল মরতে একদিন তো হবেই—এমন সত্য কথা বলিতে কয়টা মানুষকে দেখা যায়? সে-ই আমাকে এই বিপদের মধ্যে টানিয়া আনিয়াছে সত্য, কিন্তু সে যাই হোক, তাহার এত বড়ো স্বার্থত্যাগ আমি মানুষের দেহ ধরিয়া ভুলিয়া যাই কেমন করিয়া? কেমন করিয়া ভুলি, যাহার হৃদয়ের ভিতর হইতে এত বড়ো অযাচিত দান এতই সহজে বাহির হইয়া আসিল- সে হৃদয় কী দিয়া কে গড়িয়া দিয়াছিল। তার পরে কতকাল কত সুখ-দুঃখের ভিতর দিয়া আজ এই বার্ধক্যে উপনীত হইয়াছি। কত দেশ, কত প্রান্তর, কত নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল ঘাঁটিয়া ফিরিয়াছি, কত প্রকারের মানুষই না এই দুটো চোখে পড়িয়াছে, কিন্তু এত বড়ো মহাপ্রাণ তো আর কখনও দেখিতে পাই নাই। কিন্তু সে আর নাই। অকস্মাৎ একদিন যেন বুদবুদের মতো শূন্যে মিলাইয়া গেল। আজ মনে পড়িয়া এই দুটো শুষ্ক চোখ জলে ভাসিয়া যাইতেছে—কেবল একটা নিষ্ফল অভিমান হৃদয়ের তলদেশ আলোড়িত করিয়া উপরের দিকে ফেনাইয়া উঠিতেছে। সৃষ্টিকর্তা ! এই অদ্ভুত অপার্থিব বস্তু কেনই বা সৃষ্টি করিয়া পাঠাইয়াছিলে, এবং কেনই বা তাহা এমন ব্যর্থ করিয়া প্রত্যাহার করিলে। বড়ো ব্যথায় আমার এই অসহিষু মন আজ বারংবার এই প্রশ্নই করিতেছে-ভগবান। টাকাকড়ি, ধন-দৌলত, বিদ্যাবুদ্ধি ঢের তো তোমার অফুরন্ত ভাণ্ডার হইতে দিতেছ দেখিতেছি, কিন্তু এত বড়ো একটা মহাপ্রাণ আজ পর্যন্ত তুমিই বা কয়টা দিতে পারিলে ?
"(সমাপ্ত)"