গগন-পটো (Gagan-poto) অক্ষয়চন্দ্র সরকার নবম শ্রেণীর বাংলা গল্প ।। wb class 9 bengali golpo

গগন-পটো (Gagan-poto)অক্ষয়চন্দ্র সরকার রচিত নবম শ্রেণীর বাংলা গল্প গল্পটি আপনারা অনলাইন অথবা পিডিএফ ডাউনলোড করতে পারেন।


ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক


              লেখক :-অক্ষয়চন্দ্র সরকার

লেখকের পরিচিত :-

অক্ষয়চন্দ্র সরকার (জন্ম: ১১ ডিসেম্বর ১৮৪৬ – মৃত্যু:২ অক্টোবর ১৯১৭) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক। রায়বাহাদুরের পুত্র হয়েও ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের প্রবল সমর্থক অক্ষয়চন্দ্র দেশীয় শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও স্বায়ত্তশাসনের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন। লেখকের সম্বন্ধে আরো পড়ুন





 গগন-পটোকে তোমরা সকলেই দেখিয়াছ; পথে-ঘাটে দাঁড়াইয়া কতবারই দেখিয়া থাকিবে। কিন্তু তোমরা সকলে তাহার গুণাগুণ জান না, তাই আমাদিগকে আজ তোমাদের কাছে সেই পরিচিতের পরিচয় দিতে হইতেছে।

কারিগর লোক প্রায়ই একটু খামখেয়ালি হয়; কেহ বদমেজাজের উপর খামখেয়ালি, আর কেহ-বা রসখ্যাপার উপর খামখেয়ালি। কিন্তু গগন-পটোর মতো খামখেয়ালি রসখ্যাপা লোক আর দুনিয়ায় নাই। সে যদি কখনও কাহারও ফরমাশ মতো চিত্র করিল! আপনার মনে আপনার ঝোঁকে নিয়তই আঁকিতেছে, আর পুঁছিতেছে, কিন্তু যখন যেটা দাঁড় করাইবে, সেটা একেবারে চূড়ান্ত। যেমন রং আর তেমনি 'শেড'; যেমন ভাবভঙ্গি, তেমনি অঙ্গসৌষ্ঠব! তাহাতেই বলিতেছিলাম, গগন-পটো খামখেয়ালি বটে, কিন্তু মস্ত কারিগর।

তবে গগনের অনেক সময় সময়-অসময় বোধ নাই। প্রথম আলাপে সেইজন্য গগনের উপর বড়ই বিরক্ত হইতে হয়; কিন্তু তাহার পর ঘনিষ্ঠতা হইলে বুঝা যায়, লোকটা অসাময়িক হইলেও বদরসিক নহে; রসখ্যাপা বটে, কিন্তু তাহার অন্তরের অন্তরে লুকানো ছাপানো সহৃদয়তা বিলক্ষণ আছে। তবে সহিতা না থাকিলে, ঘনিষ্ঠতা না হইলে তাহার সেই ভাবটুকু কিন্তু বুঝিয়া উঠা ভার।

তুমি স্বজনের সদ্যোনাশে শোকে জরজর, সংসার আঁধার দেখিতেছ, থাকিয়া থাকিয়া তলদেশে মেদিনী ঘুরিতেছে, বাতাসে হুহু করিয়া সেই স্বজনের নাম ধ্বনিত হইতেছে, বুকের ভিতর বামদিকে কে যেন কীলক পুঁতিয়া দিয়াছে,– ঘোরতর বিষাদে তুমি অবসন্ন হইয়াছ। আকুলস্বরা কুলকুলনাদিনী কল্লোলিনীর তীরে তুমি অবসাদে উপবিষ্ট হইয়া আছ। দূরে গগন-পটোর চিত্রপটে তোমার দৃষ্টি পড়িল। সে যেন তোমাকেই ভুলাইবে বলিয়া রং ফলাইয়া বসিয়া ছিল; তুমি চাহিবামাত্র অমনই তাড়াতাড়ি পরিষ্কার পটে আঁকিতে বসিয়া গেল। শোকগম্ভীর হৃদয় সহজেই এক-মনস্ক হয়,— তুমি একমনে সেই অপূর্ব চিত্রণ দেখিতে লাগিলে। তোমার সেই স্বজনের সৌম্যমূর্তিই-বা আঁকিবে। তা-তো নয়!— ভীষণদংষ্ট্র একটা বিষম ব্যাঘ্র কাহাকে যেন কামড়াইয়া রহিয়াছে। তোমার বোধ হইল, সেই ব্যাঘ্রদষ্ট ব্যক্তিই যেন তোমার স্বজন। তোমার বুকের শেল কে যেন নাড়িয়া দিল, তোমার মর্ম-জ্বালা হইল, —গগন-চিত্রকরকে মহা নিষ্ঠুর স্থির করিয়া মহা বিরক্ত হইলে।

তুমি মুখ ফিরাইবে, এমন সময় চকিতের মধ্যে দেখিলে যে, চিত্রপটে আর সে ভয়ানক ব্যাঘ্র নাই, তোমার সেই ভূপাতিত বন্ধু সৌম্যমূর্তিতে গগনের পট শোভা করিতেছেন, আর, একখানি সুন্দর হস্ত যেন তাঁহাকে আস্তে আস্তে কোথায় মন্দ মন্দ লইয়া যাইতেছে। তোমার প্রাণ যেন একটু শীতল হইল, তুমি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলে; ভাবিলে, গগন-পটো খ্যাপা হউক, আর যাহাই হউক—মনের কথা বুঝিতে পারে,— পোড়া মন একটু শীতল করিতে পারে। মনে যদি একবার ধারণা হয় যে, লোকটা সহৃদয় এবং তোমার ব্যথার ব্যথী, তাহা হইলেই তাহাকে ভালোবাসিতে হয়। আর হৃদয় যখন শোকে-তাপে গম্ভীর, তখন ভালোবাসাও এক দিনে এক মুহূর্তে প্রগাঢ় হইয়া পড়ে। তুমি অন্তরের অন্তরে বুঝিলে যে, গগন তোমার ব্যথার ব্যথী, অমনই যেন তাহার উপর তোমার একটু ভালোবাসা জন্মিল। তুমি নদীতীরস্থ শল্পশয্যায় শায়িত হইয়া একমনে, স্থিরনয়নে গগনের খামখেয়ালির কারিগরি পর্যালোচনা করিতে লাগিলে।

গগন আঁকিল—একটা বৃহৎ কুম্ভীর, সূচালো মুখ, কর্কশ গাত্র, কণ্টকিত লাঙ্গুল কপিল বর্ণ, ভয়ঙ্কর ভঙ্গি— সব ঠিকঠাক হুবহু – যেন অগাধ নীল জলে সাঁতার দিতেছে। হঠাৎ কুম্ভীর দ্বিখণ্ডীকৃত হইল, গায়ের কাঁটাগুলি তুলার মতো ফুলো ফুলো হইল, মুখকোণ সংযত হইল, রংটা কেমন একটু ঘোলা ঘোলা হইল। পরক্ষণেই দেখো, দুইটি নিরীহ মেষ পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি সেই নীল প্রান্তরে শনৈঃশনৈঃ বিচরণ করিতেছে। তুমি ভাবিতেছ, ভয়ঙ্কর কুম্ভীর যমজ মেষশিশু হইল; ভাবিতে না ভাবিতেই সে চিত্র নাই। সেই মেষদ্বয়ের স্থলে বিচিত্র বর্ণের বৃহৎ এক সদণ্ড পতাকা, খর খর বাতাসে যেন ফরফর করিয়া উড়িতেছে। স্বজনবিয়োগ-চিন্তা তোমার মন হইতে ক্ষণেকের তরে অন্তর্হিত হইল। বিষম রসখ্যাপা গগন তোমাকে আপনার পাগলামির কীর্তি দেখাইয়া তোমাকে হাসাইল। তোমার সেই মলিন ম্লান মুখের অধরপ্রান্তে সেই অন্তরের হাসি ঈষৎ দেখা দিল। তুমি অন্তরে বলিলে, পাগলা পটোর ভিতরের কথাটা ঠিক–সংসারের সকলই তো এইরূপ পরিবর্তনশীল, তা ওই কেবল স্থাবর চিত্র আঁকিবে কেন?

এই চিন্তায় তুমি অন্যমনস্ক হইয়াছিলে,— দেখিলে সে বিচিত্র নিশান আর নাই, – মৃদু আভায় একটি স্থির চিতা যেন ধীরিধীরি জ্বলিতেছে। সেই চিতার মধ্যে অস্পষ্ট অবয়বে তোমার সেই স্বজনের শবমূর্তি। শবদেহ কিন্তু নিষ্প্রভ নহে,—সূর্যাস্ত-কালের পূর্বদিকের পাতলা মেঘের উপর ক্ষীণ রামধনুর ন্যায় একটু হাসি যেন সেই মুখপ্রান্তে দেখা দিতেছে, চক্ষুদ্বয়ের প্রশান্ত শীতল জ্যোতি গগনের চিত্রান্তরে যেন স্থাপিত রহিয়াছে।

দিব্যাঙ্গনা ভাসিয়া ভাসিয়া নিম্নস্তরের চিতার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন, নিম্নস্তরের চিতাও শবদেহ লইয়া দিব্যাঙ্গনার দিকে প্রবাহিত হইতে লাগিল, — কাছাকাছি হইল, তোমার চক্ষুতে জল আসিল; চক্ষু মুছিয়া চাহিয়া দেখিলে সে সব আর কিছু নাই,— গগন-পটো নীল পটের এখানে-সেখানে কেবল কাঁচা সোনার স্তবক আঁটিতেছে, আর তাহাতে জরদ, ধূমল, পাংশু কত বিচিত্র রঙের শেড দিতেছে। তুমি উঠিয়া বসিলে, দির্ঘনিশ্বাস ফেলিলে, এবার মুখ ফুটিয়া বলিয়া উঠিলে,—‘গগন সকলকেই জানে,— সকলকেই চেনে; আমরা কিন্তু উহাকে কেহই চিনিতে পারিলাম না। দেখো, আমাদের সকল সংবাদই রাখে, আমরা কিন্তু উহার কিছুই জানি না।

গগনের কার্যসাধন হইয়াছে। তাহার সহিত একবার ঘনিষ্ঠতা করিলেই সে তাহার অস্থাবর পট দেখাইয়া তোমার কিছু-না-কিছু ভালো করিবেই। হয় তোমার মনের কবাট খুলিয়া দিবে, নয় তোমার শোকের সান্ত্বনা করিবে। কখনও হয়তো তোমার আনন্দের সংবর্ধনা করিবে, আবার কখনও হয়তো তোমাকে ধর্মের দিকে আকর্ষণ করিবে। আজ সে তোমার শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে সান্ত্বনা দান করিয়াছে, তোমার মাথা হাল্কা হইয়াছে বটে, — এখন আর ঘুরিতেছে না; বাতাস এখনও হু হু করিতেছে— এখনও পিলুরাগিণীতে ভরিয়া আছে, কিন্তু এখন তো আর তোমার বন্ধুর নাম করিয়া কাঁদিতেছে না; বুকে এখনও শেল বাঁধিয়া আছে বটে, কিন্তু তেমন করিয়া আর তো কেহ তাহাকে মোচড় দিতেছে না। গগনের কার্য সমাধা হইয়াছে। গগন তোমার শোকবহ্নির প্রখরতা নষ্ট করিয়াছে। তুমি এবার ধীরে ধীরে ফিরিয়া দেখিলে পশ্চিমের দিক্-চক্রবাল ব্যাপিয়া ঘন সন্নিবেশিত শাল-বিটপি-আচ্ছাদিত পর্বত-বেদীর উপরি জ্বলন্ত কাঞ্চনরাগে এক অপূর্ব প্রতিমা দীপ্তি পাইতেছে। গগন-পটোর সেই এক প্রিয় প্রতিমা। মাস মাস ধরিয়া প্রত্যহই আঁকে, আর প্রত্যহই পুঁছিয়া ফেলে,— তাহার বিরক্তিও নাই, তৃপ্তিও নাই।

ওই প্রতিমা একখানি আশ্চর্য ছবি। গগন-পটো প্রায়ই প্রত্যহ আঁকে, আর আমরাও তো প্রায়ই প্রত্যহ দেখি, তবু নিত্যই নূতন। পুরাণের পুরাণ মহাপুরাণকে নূতন করিয়া দেখাইতে গগন-পটো যেমন পটু, এমন আর দ্বিতীয় নাই। কিন্তু কেবল তাই বলিয়া যে পশ্চিমের প্রতিমা আশ্চর্য ছবি, তাহা নহে। ও-এক আজগুবি কাণ্ড।— মুখ নাই অথচ দেখ কেমন হাসিতেছে; চোখ নাই, ভ্রু নাই— তবু দেখ কেমন চোখ রাঙাইয়া ভ্রুকুটি করিয়া রহিয়াছে। আর আশ্চর্যের আশ্চর্য— ওই মধুর হাসিতে আর ওই ভীষণ ভ্রুকুটিতে দেখো দেখি কেমন মাখামাখি, কেমন মেশামেশি। ওই দেখো কেমন অপূর্ব হাসি! ঢলঢল তপ্ত কাঞ্চনসাগরে যেন অমৃতের লহরী উঠিল। ওই দেখো কেমন রাগ! ব্রহ্ম-কোপানলে যেন খাণ্ডব দাহ হইবে। ওই দেখো নিঃশব্দ, তবু যেন তোমাকে স্বর্গের বার্তা ধীরে ধীরে বুঝাইয়া দিতেছে; চক্ষু নাই, তবু যেন তোমার মনের অন্তস্তল পর্যন্ত দেখিতে পাইতেছে। আর দেখো, নিশ্চল, সুস্থির— তথাপি যেন হাত তুলিয়া তোমাকে অভয়দান করিতেছে, আশীর্বাদ করিতেছে। এসো, আমরা প্রণত হই। সঙ্গে সঙ্গে মহাশিল্পী গগন-চিত্রকরকে নমস্কার করি এবং তাহার ওস্তাদকে একবার দেখাইবার জন্য তাহার কাছে প্রার্থনা করি।

গগন-দাদা! তোমার খ্যাপামিতে ক্ষান্ত দিয়া একবার আমাদের গুটিকত কথা শুন। গঙ্গার উপর তোমার প্রভাতচ্ছবি, পর্বত পৃষ্ঠে তোমার এই সন্ধ্যার প্রতিমা, প্রাবৃটের সেই ঘনকৃষ্ণ সিংহাসন, নিদাঘের সেই রৌদ্রমূর্তি—ও-সকল কারিগরি তোমার অনেকবার দেখিয়াছি। তোমার বিচিত্র পট দেখিয়া অনেকবার জ্বলিয়াছি, পুড়িয়াছি, হাসিয়াছি, কাঁদিয়াছি; কিন্তু ওই সকল বিচিত্র চিত্রে আত্মহারা হই বটে, অথচ পরমার্থ পাই না, তুষ্টি হইলেও তৃপ্তি হয় না। না দাদা আর খ্যাপামি করিয়া আমাকে ভুলাইবার চেষ্টা করিয়ো না। তোমার এই সকল ছায়াময়ী প্রতিমার অন্তরস্থ প্রতিমা আমাকে সেই সেদিনের মতো আর একবার দেখাও। তোমার সেই বিষম ভেলকি আর একবার ভাঙিয়া দাও। এই ছায়াবাজির ছায়াপট একবার ক্ষণমুহূর্ত-জন্য সরাইয়া দাও- আমি আর একবার তোমার সেই নীল, নীল, অতি নীল বাজিঘরের অভ্যন্তরস্থ তোমার ওস্তাদকে প্রাণ ভরিয়া দেখিব। সেদিন তুমি দেখাইলে বটে, কিন্তু আমি যে কী দেখিলাম, তাহার কিছুই বুঝিলাম না। কোমলের কোমল অতি কোমল বংশীরবে আমার মোহ হইল; নীল-মধ্যে অতি নীল দেখিতেছিলাম, সমস্ত জগৎ নীল আভায় প্রতিভাত হইল—আমি আর কিছুই দেখিতে পাইলাম না। তাহার পর তুমি তোমার ছায়াপটে তুলারাশি ছড়াইয়া হাসিতে লাগিলে। না দাদা! তোমার পায়ে পড়ি, এবার আর ও-সময়ে খ্যাপামি করিও না; ভালো করিয়া তোমার ওস্তাদকে একবার দেখাও।



                               সমাপ্ত


                পিডিএফ ডাউনলোড করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনাদের কোন প্রশ্ন থাকলে দয়া করে জানাবেন ।