![]() |
| ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক |
লেখক-: মতি নন্দী
লেখকের পরিচিত :- মতি নন্দী (১০ জুলাই ১৯৩১ - ৩ জানুয়ারি ২০১০) ছিলেন ভারতের কলকাতার একজন বাঙালি লেখক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মতি নন্দী ছিলেন মূলত ক্রীড়া সাংবাদিক এবং উপন্যাসিক ও শিশু সাহিত্যিক। তিনি আনন্দ পুরস্কার এবং সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছেন। তার বিখ্যাত উপন্যাস 'কোনি'। লেখকের সম্বন্ধে আরো পড়ুন
অবশেষে কোনি বাংলা সাঁতার দলে জায়গা পেল ।
এবারের জাতীয় সাঁতার চ্যামপিয়নশিপ হচ্ছে মাদ্রাজে । বি এ এস এ নির্বাচন সভায় ধীরেন ঘােষ , বদু চাটুজ্জেরা প্রবল বিরােধিতা করেছিল অ্যাপােলাের কাউকে দলে নেওয়ায় । শুধু তাই নয়, জুপিটারের কম্পিটিশনে অ্যাপােলাের তরফ থেকে “ অমার্জনীয় অখেলােয়াড়ি আচরণ করার জন্য ওই ক্লাবকে সাসপেন্ড করা হােক দাবিও তােলে ।
জুপিটার দলে ভারী ছিল , তাদের প্রস্তাব গৃহীতও হচ্ছিল । এমন সময় আচমকা বালিগঞ্জ ক্লাবের প্রণবেন্দু বিশ্বাস অর্থাৎ হিয়ার কোচ প্রস্তাব দিল , “ অ্যাপােলােকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হােক , ভবিষ্যতে এই ধরনের আচরণ সম্পর্কে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে । ” প্রণবেন্দু তারপর বলল , “ বেঙ্গলের স্বার্থেই কনকচাঁপা পালকে টিমে রাখতে হবে । ”
“ হ্যাঁ দেখেছি । ” প্রণবেন্দু স্থির চোখে ধীরেনের পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বলল , “ কী হয়েছিল আমি দেখেছি । ”
শধু প্রণবেন্দু নয় , আরাে অনেকেই দেখেছে ।
কোনির প্রতিদ্বন্দ্বিতা অমিয়ার সঙ্গে নয় , হয়েছিল হিয়ার সঙ্গে । ব্রেস্ট স্ট্রোকের ১০০ মিটারে ছিল কোনি , অমিয়া , হিয়া । চ্যামপিয়নশিপের অন্যতম রেফারি ছিল ধীরেন ঘােষ । স্ট্রোক জাজদের মধ্যে ছিল হরিচরণ , ইনসপেক্টর অফ টার্নস এবং টাইম কিপারদের মধ্যে কার্তিক সাহা , বদু চাটুজ্জে , যজ্ঞেশ্বর ভটচাজ ছাড়াও জুপিটারের গােষ্ঠিভুক্ত কয়েকটি ক্লাবের লােকেরা ছিল ।
একই সঙ্গে কোনি আর হিয়া ৫০ মিটার থেকে টার্ন নেয় । সঙ্গে সঙ্গে বন্দু চাটুজ্জে লাল ফ্ল্যাগ নাড়তে শুরু করে । রেফারি ধীরেন ঘোষছুটে গিয়ে ফ্ল্যাগ দেখাবার কারণটা জেনে , বলল , “ কনকচাঁপা পাল ডিসকোয়ালিফাই হয়েছে । টার্ন করেই আন্ডারওয়াটার ভাবল - কিক নিয়েছে । ”
শুনে অবাক হয়ে গেল ক্ষিতীশ । শুধু বলল , “ এরকম ভুল করার কথা তাে নয় । ”
হিয়া প্রথম এবং তার থেকে ৬ মিটার পিছনে কোনি ৭ মিটার পিছনে অমিয়া সাঁতার শেষ করে । কোনিকে ২০০ মিটারে নামতে দেয়নি ক্ষিতীশ । ব্রেস্ট স্ট্রোকে পায়ের উপর অত্যধিক খাটুনি পড়ে , অথচ তার পরেই ২০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ইভেন্ট । কোনি মূলত ফ্রি স্টাইলার । কিন্তু এতেও কোনি পারল না । সাঁতার শেষ করে ফিনিশিং বাের্ড ছুঁয়েই সে মুখ ঘুরিয়ে দেখল অমিয়া হাত ছোঁয়াল । কোনি একগাল হেসে মুখ তুলে ক্ষিতীশের দিকে তাকাল । ঘড়িটা উঁচু করে ধরে গ্যালারি থেকে ক্ষিতীশ হাত নাড়াল । ঘােষণায় শােনা গেল অমিয়া প্রথম হয়েছে ।
ক্ষিতীশ প্রথমে থ হয়ে গেল , তারপর ধীরেনের কাছে ছুটে গিয়ে বলল , “ এসব কী হচ্ছে ? ”
“ কী আবার হবে । ” ধীরেন অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাচ্ছিল , ক্ষিতীশ ওর হাত টেনে ধরল ।
" আমিও টাইম রাখছি । কোনি আগে টাচ করেছে, ওর টাইম - "
“ তােমার জাপানি ঘড়ির টাইম তােমার কাছেই রাখো । ”
নকুল মুখুজ্জে প্রতিবাদ জানাল জুরি অফ অ্যাপিলের কাছে । প্রতিবাদ নাকচ হয়ে গেল । পনেরাে মিনিট পরেই ছিল ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলি । কোনি বাটার ফ্রাইয়ে হিয়া এবং অমিয়ার কাছে পিছিয়ে পড়ল , ব্যাক স্ট্রোকে অমিয়াকে ধরে ফেলে টান নিতেই দেখা গেল যজ্ঞেশ্বর ভটচাজ লাল ফ্র্যাগ তুলে রয়েছে ।
“ ব্যাপার কী ! ” ক্ষিতীশ গ্যালারি থেকে নেমে এল। “ ধীরেন জোচ্চুরির একটা সীমা আছে । জগু তাে আগে থেকেই ফ্ল্যাগ তুলেছিল । ”
“ কে বলল আগে থেকে ! তােমার মেয়েটা ফলটি টান নিয়েছে , তারপর ফ্ল্যাগ দেখিয়েছে । শেখাও শেখাও , টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলাে শেখাও । জুপিটারকে অপদস্থ করা ছাড়া আর কিছু তাে শেখাওনি । ” ধীরেন উত্তেজিতভাবে হাত নেড়ে বকের মতাে গলাটা লম্বা করে বলতে লাগল , “ আইনটাও শিখাে যে , ব্যাক স্ট্রোকে টার্ন নেবার জন্য বাের্ডে হাত ছোঁয়াবার আগে নরম্যাল পজিশন অন দি ব্যাক থাকতে হবে । কনকচাঁপা ঘুরে গিয়ে হাত ছুইয়েছে , নরম্যাল পজিশনে থেকে ছোঁয়ায়নি । যাও যাও , গিয়ে বােসাে এখন । ”
হিয়ার কাছে অমিয়া হেরে গেল এক সেকেন্ডের তফাতে । কোনি আড়ষ্ট হয়ে গেল দু’বার বাতিল হয়ে এবং প্রথম হয়েও দ্বিতীয় হয়ে যাওয়ায় । বাড়ি ফেরার সময় ক্ষিতীশ বাসে সারা পথ গজরাল এবং অবশেষে বলল , “ কাল হানড্রেড মিটার , দেখি ধীরেনরা কী করে তােকে আটকায় । ”
কিন্তু আটকাবার যে অনেক পন্থা আছে ক্ষিতীশ তা ভেবে দেখেনি ।
পরদিন স্টার্টিং ব্লকে যখন প্রতিযােগীরা এসে দাঁড়াল , ক্ষিতীশ একটু অবাকই হলাে । নিয়ম অনুযায়ী , প্রতিযােগীদের মধ্যে যারা সেরা তাদের মাঝখানে রাখা হয় , – ৩ , ৪ , ৫ নম্বর লেনে । হিয়া ৩ নম্বরে , কোনি ৪ নম্বরে , অমিয়া ৬ নম্বরে আর তাদের মাঝে জুপিটারের ইলা ৫ নম্বর লেনে । হিটে কোনােক্রমে তৃতীয় হয়ে ইলা ফাইনালে উঠেছে । দু বছর আগে প্রি - ইউ পরীক্ষায় টোকার সময় ধরা পড়ে ইলা গার্ডকে কামড়ে দিয়েছিল ।
ক্ষিতীশ এগিয়ে যাচ্ছিল ধীরেনের দিকে । একজন ভলান্টিয়ার তাকে আটকে দিয়ে বলল “ প্ল্যাটফর্মে কম্পিটিটাররা আর অফিসিয়ালরা ছাড়া কেউ যেতে পারবে না । ”
ফিরে এসে ক্ষিতীশ ঘড়ি হাতে নিয়ে বসল । শুরু থেকেই প্রচণ্ড রেস । অমিয়া বদ্ধপরিকর চ্যামপিয়নশিপ বজায় রেখে সতার থেকে বিদায় নিতে । হিয়া মসৃণ ছন্দোবদ্ধ এবং দ্রুততালে নিখুত ভঙ্গিতে ভেসে যাচ্ছে । কোনি যেন তাড়া খাওয়া ব্যস্ত উদ্বিগ্ন জলকন্যা । জল তােলপাড় করে সে যেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলেছে । বাকিরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে ওই তিনজনের পিছনে অন্তত ২০ মিটারের মধ্যে থাকতে । ইলার ব্যস্ততাটা একটু কম , সে বরাবর মুখ তুলে তাকাচ্ছে আর ক্রমশই সরে যাচ্ছে কোনির লেনের দিকে ।
বাের্ড ছুঁয়ে সবার আগে টার্ন নিল কোনি । তারপর অমিয়া । ব্রেস্ট স্ট্রোকাররা ভালাে ফ্রি স্টাইলার হয় না – হিয়া প্রায় দু ' মিটার পিছিয়ে পড়েছে । বাকিরা তখনাে ৪০ মিটারেও পৌঁছয়নি । টার্ন নিয়ে কোনি সবে মাত্র দু - তিনটি স্ট্রোক দিয়েছে , তখনই ব্যাপারটা ঘটল ।
ইলা ঢুকে পড়েছে কোনির লেনে । দুজনে মুখােমুখি সংঘর্ষ । “ উঃ " বলে কোনি চেঁচিয়ে উঠল একবার , দেখা গেল ওরা জড়াজড়ি অবস্থায় এবং হাঁকপাক করে সে যেন নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে । কয়েক সেকেন্ড এভাবেই কাটল । ততক্ষণে অমিয়া এবং হিয়া ওদের অতিক্রম করে বেরিয়ে গেছে । বদু চাটুজ্জে লাল ফ্ল্যাগ উচিয়ে ইলার দিকে তাকিয়ে বলল ,“ ইউ ডিসকোয়ালিফায়েড । ” ইলা আবার নিজের লেনে সরে গিয়ে সাতার কেটে স্টার্টিং প্ল্যাটফর্মের দিকে ফিরে যেতে লাগল ।
কোনি শুধু একবার সামনে তাকিয়ে দেখল । তারপরেই বড়াে হাঁ করে অনেকখানি বাতাস বুকে ভরে নিয়ে তাড়া করল সামনের দুজনকে । অনেক দেরি হয়ে গেছে , তবু শেষ চেষ্টা । এঞ্জিনের পিস্টনের মতো ওঠানামা করছে দুটো হাত , পায়ের কাছে টগবগিয়ে ফুটছে জল ।
“ কাম অন পল , কাম অন । ” দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচাচ্ছে আর কেউ নয় , হিয়ার বাবা । গ্যালারির হতভম্ব ভাবটা তাতে যেন ভেঙে খানখান হয়ে পড়ল ।
“ জোরে জোরে , আরাে জোরে । ” শুধু এই চিৎকার ধাপে ধাপে উঠে অবশেষে আক্ষেপে ভেঙে পড়ল । কোনি পারল না । অমিয়া তার খেতাব রক্ষা করল । দ্বিতীয় হলাে হিয়া । কোনি তৃতীয় হলাে বেলার সঙ্গে ।
তারপর আর একটি ব্যাপার ঘটল । ধীরেন জলের ধারে ঝুঁকে এক গাল হেসে অমিয়াকে কিছু বলছিল , সেই সময় ভিড় ঠেলে ছুটে এসে ক্ষিতীশ তার পিছনে লাথি কষাল । ধীরেন উল্টে গিয়ে জলে পড়ল । তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল । কয়েকটি ছেলে ক্ষিতীশকে হিচড়ে সরিয়ে নিয়ে গেল সেখান থেকে । তখন শােনা গেল চিৎকার করে সে বলে যাচ্ছে , “ পারবি না , এভাবে পারবি না ।... ”
রাস্তায় বেরিয়ে এসে কোনির তােয়ালে দিয়ে ক্ষিতীশ মুখ মুছল । ঠোঁটের কষ বেয়ে তখনাে রক্ত গড়াচ্ছে । কোনির কপাল ফুলে উঠেছে । একটা পানের দোকান দেখে ক্ষিতীশ বরফ কেনার জন্য দাঁড়াল । ঠিক তখনই ওর পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হিয়ার বাবা নেমে এল ।
“ সরি মিস্টার সিনহা । এমন ডার্টি ব্যাপার এখানে হবে আমি জানতাম না । হিয়া , তার মা , আমরা কেউই খুশি হতে পারছি না । এভাবে মেডেল জেতায় কোনাে আনন্দ নেই । ”
ভদ্রলােক কোনির পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন , “ দুঃখ কোরাে না । জোরে সাঁতার কাটার দরকারটা আজ তুমি অনুভব করতে পেরেছ , তুমি লাকি । তােমার লাস্ট ফরটি মিটারস আমি ভুলব না । ”
ক্ষিতীশ প্রথমে বিভ্রান্ত তারপর অভিভূত হয়ে গেল। গাড়ির জানলা দিয়ে হিয়া এবং তার মা দেখছে । ক্ষিতীশ এগিয়ে এসে হিয়ার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বলল , “ বড়াে হও মা । ” তারপর ইতস্তত করে বলল , “ সেদিন কোনিকে আমি খুব বকেছি । ”
বাস স্টপে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির ছেড়া বুক পকেটটা টান মেরে ক্ষিতীশ খুলে ফেলল ।
“ তাের বৌদিকে এসব কিছু বলিসনি । ” ...
প্রণবেন্দু ঘরের সকলের মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল , “ কী হয়েছিল , আমরা জানি। সেকথা এখন আলােচনা । করে লাভ নেই । বাংলার মানসম্মানের কথাই এখন আমাদের ভাবতে হবে , টিমটা যাতে সেরা হয় তার জন্য তুচ্ছ দলাদলি ভুলে যেতে হবে । মহারাষ্ট্রই আমাদের মেয়েদের একমাত্র রাইভ্যাল । ওদের রমা যোশির সঙ্গে ফ্রি স্টাইলে পাল্লা দেবার মতাে কেউ নেই , একমাত্র কনকচাঁপা পাল ছাড়া । ফ্রি স্টাইলে তিনটে ইনডিভিজুয়াল , আর একটা বিলে , এই চারটের মধ্যে অন্তত দুটোতে , একশাে আর দু'শােয় কনকচাপার সিক্সটি পারসেন্ট চান্স আছে । ”
“ কীসে বুঝলে যে , আছে ? " একজন জানতে চাইল ।
“ শুধু ওর সেদিনের ফিনিশ করা দেখেই বুঝেছি । যেরকম রােখা জেদি সাঁতার ও দেখাল , তাতে প্রিন্ট ইভেন্টে ওর সমকক্ষ এখন বাংলায় কেউ নেই । আমি ওর ট্রেনিংয়ের খবর রাখি , দু - তিনবার দেখেও এসেছি , জোর দিয়েই বলছি মহারাষ্ট্রের কাছ থেকে চ্যামপিয়নশিপ ছিনিয়ে নিতে হলে এই মেয়েটিকে চাই । ”
“ শুধু ফ্রি স্টাইল জিতেই আমরা চ্যামপিয়ন হয়ে যাবো ? ” ধীরেন ঘােষ তাচ্ছিল্যভরে বলল এবং অন্যান্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞের মতাে হাসল । কিন্তু তাকে সায় দিয়ে কেউ মাথা নাড়ল না এবার ।
“ হিয়ার কাছ থেকে আমি তিনটে গােল্ডআশা করছি । দুটো ব্রেস্ট স্ট্রোকে , একটা ব্যাক স্ট্রোকে। মেডলিতেও ফিফটি - ফিফটি চান্স আছে । এছাড়াও অঞ্জু , পুষ্পিতা , বেলা ও অমিয়া পয়েন্ট আনবে । এ বছর আমরা লেডি চ্যাম্পিয়ন হতে পারি । ”
“ কিন্তু কনকচাঁপা পাল এ বছর কোনাে ক্লাব স্পোর্টসে নামেনি , স্টেট চ্যামপিয়নশিপে দুটোতে ডিসকোয়ালিফাই হয়েছে । আর একটায় প্রথম দুটো প্লেসের মধ্যে আসতে পারেনি , বাকিগুলােয় আর নামেনি । ওর টাইমিং কী , আমরা তা জানি না । সুতরাং কী করে ওকে সিলেক্ট করা যায় । ” ধীরেন ঘােষ টেবল ঘুষি মেরে চেঁচিয়ে উঠল ।
কয়েক সেকেন্ড সভাঘর নিস্তব্ধ রইল । সবশেষে ধীর শান্ত গলায় প্রণবেন্দু বলল , “ তাহলে বালিগঞ্জ সুইমিং ক্লাবের সুইমারদের বাদ দিয়েই আপনাদের টিম করতে হবে । আমার মেয়েদের আমি উইথড্র করে নিচ্ছি । ”
“ তা কী করে হয় । সভায় গুঞ্জন উঠল । একজন বলল , “ কনকচাঁপা পলকে সিলেকশন দিলে ক্ষতিই বা কি । যাবে তাে নিজের টাকায় । ”
এরপর শুরু হলাে তর্কাতর্কি । সেটা পৌছল চিৎকারে । এক সময় ধীরেন রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । যাবার সময় বলল , “ প্রণবেন্দু ব্ল্যাকমেল করে অ্যাপােলাের সুইমার টিমে ঢােকাতে চায় । এতে ওর কী যে স্বার্থ আছে বুঝছি না । ”
প্রণবেন্দু জবাব দিল , “ রমা যােশির সােনা কুড়ােনাে বন্ধ করা ছাড়া আমার আর কোনাে স্বার্থ নেই । ”
কোনি মাদ্রাজ যাওয়ার মনােনয়ন অবশেষে পেল । বাংলা ম্যানেজার হয়েছে ধীরেন ঘােষ । মেয়েদের বিভাগে ম্যানেজার বেলেঘাটা সুইমিং ক্লাবের প্রণতি ভাদুড়ি এবং কোচ হরিচরণ মিত্র । মাদ্রাজ মেলে ওরা সন্ধ্যায় রওনা হবে । ক্ষিতীশ এসেছে ট্রেনে কোনিকে তুলে দিতে । আর এসেছে কান্তি , চন্ডু , ভাদু । কোনির ভাই গােপাল ।
কামরায় জানলার ধারে বসেছে কোনি । জানলা থেকে দূরে সবার থেকে একটু তফাতে প্ল্যাটফর্মে ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে । কোনি কথা বলছে কান্তিদের সঙ্গে । ধীরেন ঘােষ হাঁকডাক করে তদারকিতে ব্যস্ত । ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসছে , এখনাে নাকি কয়েকজন পোঁছয়নি ।
কোনির মুখে চাপা ভয় । কলকাতায় বাইরে সে কখনাে যায়নি । সাড়ে চোদ্দোশাে কিলােমিটার অর্থাৎ প্রায় ৩৫ ঘণ্টা ট্রেনে বাস । কামরার আর এক কোণে জুপিটারের অমিয়া আর বেলা । ওরা অভ্যস্ত । এটা ওদের পঞ্চম ন্যাশনাল চ্যামপিয়নশিপ । হিয়া বাবা - মার সঙ্গে দু - দিন পর প্লেনে যাবে ।
কোনি কথা বলছে আর মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে ক্ষিতীশের দিকে । তখন চোখ সরিয়ে নিচ্ছে ক্ষিতীশ ।
“ মাদ্রাজ একেবারে সমুদ্রের ওপর । তবে নামিসনি যেন । গঙ্গা আর সমুদ্রে অনেক তফাত । সমুদ্রের তলায় কারেন্ট আছে । ” ভাদু সাবধান করে দিল ।
“ কোনি মুশকিলে পড়বি খাবার নিয়ে । ইডলি ধােসা যা জিনিস , খেলেই মালুম পাবি । বাঙালিদের পেটে ওসব ঠিক সহ্য হবে না । ওখানে পৌছেই খোঁজ করবি বাঙালি হােটেল - ফোটেল কোথায় আছে । ” কান্তি পরামর্শ দিল ।
“ না রে আমাদের সঙ্গে রান্নার জিনিসপত্তর , ঠাকুর সব যাচ্ছে । ”
“ তাের ভয় কচ্ছে ? ” ভাদু জিজ্ঞেস করল ।
কোনি ছলছল চোখে তাকাল ।
“ আরে ধেৎ , তাের থেকেও কত ছােটো ছােটো মেয়ে ওয়ার্ল্ড ঘুরছে একা । আর তুই তাে অ্যাতােগুলাে লােকের সঙ্গে যাচ্ছিস । ঘাবড়াসনি । ” চন্ডু হাত ধরল কোনির ।
ট্রেন ছাড়ার ঘন্টা পড়ল । ক্ষিতীশ কথা বলছিল একজনের সঙ্গে । মুখ ফিরিয়ে দেখল । কোনি তার দিকে তাকিয়ে , দু’গাল বেয়ে জল পড়ছে ।
“ ক্ষিন্দা । ” কোনি ধরা গলায় ডাকল ।
ক্ষিতীশ না শােনার ভান করল ।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ।
“ আমার ভয় করছে ক্ষিদ্দা । ”
ট্রেনের সঙ্গে হাঁটছে কান্তিরা । মুখ কাত করে কোনি জানলার শিকের ফাক দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল ক্ষিতীশকে , দেখতে পেল না ।
ঘণ্টা দুয়েক পর খড্গপুর স্টেশনে ট্রেন থামল । কৌতূহলে কোনি প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে । হঠাৎ পাশ থেকে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল ক্ষিতীশ ।
“ ক্ষিদ্দা ! ” কোনির চিৎকারে শুধু কামরারই নয় , প্ল্যাটফর্মেরও অনেকে ফিরে তাকাল ।
“ মনে আছে তাে ঠিক দশটায় ঘুমােবি । ”
“ না । ” অবাধ্য গোয়ারের মতাে কোনি ঘনঘন মাথা দোলাল । টপ টপ করে চোখ থেকে জল ঝরছে । “ আমি কিছু শুনব না , করবও না । তুমি মাদ্রাজ যাবে , এটা আমার কাছে লুকিয়েছিলে কেন ? ”
একজন টিকিট চেকারকে এগিয়ে আসতে দেখে ক্ষিতীশ আড়ষ্ট হয়ে গেল । লােকটি তার পিছন দিয়ে চলে যাবার পর কোন কামরায় ওঠে , সেদিকে আড়চোখে নজর রাখতে রাখতে সে বলল , “ যাচ্ছি কে বলল , এখান থেকেই আমি কলকাতায় ফিরে যাব । ”
“ ইসস । ” কোনি দু ' হাতে আঁকড়ে ধরল ক্ষিতীশের পাঞ্জাবির হাতা । “ যাও তাে দেখি । ”
“ কেন আমি যাব । তুই কি কখনাে আমার কথা ভাবিস ? ”
“ ভাবি কি না ভাবি , তুমি তা জানাে ? ”
“ জানিই তাে । জলে ডাইভ দিয়ে পড়ার পরই তাে আমাকে ভুলে যাস । ”
টিকিট চেকারটি আবার আসছে । কোনি উত্তর দেবার আগেই ক্ষিতীশ , “ কাল সকালে বহরমপুরে আসব ” , এই বলেই সরে গেল ।
কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে হরিচরণ একজনকে বলল , “ আপদটা দেখছি সঙ্গে চলেছে । ”
কিন্তু সকালে ক্ষিতীশকে দেখা গেল না । বিনা টিকিটে ভ্রমণের জন্য রাত্রেই চেকারের হাতে ধরা পড়ে সে তখন রেল পুলিশের হেফাজতে ।
