আলুবাবু (Alubabu) বনফুল - বাংলা দশম শ্রেণির গল্প | সাহিত্য সঞ্চয়ন দশম শ্রেণী উৎস সন্ধানে

আলুবাবু - বনফুল - বাংলা দশম শ্রেণির গল্প - 2020 class x bangali Sahitya-Sonchayan ।। সাহিত্য সঞ্চয়ন দশম শ্রেণী উৎস সন্ধানে



ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক


 "লেখক :- বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)"


"লেখকের পরচিতি :-"

জন্ম:- ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 

মৃত্যু: ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফ্রেব্রুয়ারি কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।




বাই তাঁকে আলুবাবু বলত , কিন্তু তার আসল নাম আলাে । চেহারা অবশ্য নামের উপযুক্ত নয় । গায়ের রং কুচকুচে কালাে , মুখটি বেগুন - পােড়ার মতাে , তাঁর উপর কালাে গোঁফ - দাড়ি , যুগ্ন - ভ্রু , মাথায় ঘাড় পর্যন্ত লম্বা বাবরি  চুল । গলায় তুলসীর মালা , সেটিও কালাে হয়ে গেছে । পরনের থানখানি অবশ্য ধপধপে সাদা । গায়ের চাদরখানিও সাদা । আলুথালু জামা গায়ে দিতেন না , জুতােও পরতেন না ।

একদিন সকালে আমার বৈঠকখানায় ঢুকে নমস্কার করে কঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন । সেই দিনই প্রথম দেখলাম তাকে ।

কী চাই আপনার ?

অনুগ্রহ করে একটু সাহায্য করবেন আমাকে ?

 সাহায্যপ্রার্থী অনেক আসে , অধিকাংশ লােকই টাকা চায় , ভাবলাম ইনিও বােধ হয় সেই দলের মনে মনে একটু বিরক্ত হলাম , কিন্তু মুখ ফুটে বিরক্তি প্রকাশ করতে পারলাম না । বরং বললাম , অসম্ভব না হলে নিশ্চয়ই করব । বলুন , কী করতে হবে - 

তার বাঁ হাতে একটি ছােটো থলি ছিল । তার ভিতর হাত ঢুকিয়ে তিনি একটি ছােটো পাখির ছানা বার করলেন।

একটা ছোঁড়া এই পাখির ছানাটার পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছিল । আমি দু আনা পয়সা দিয়ে বাচ্চাটা নিয়ে নিয়েছি তার কাছ থেকে । মনে হচ্ছে এর পায়ে লেগেছে , পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছিল কিনা , একটু দেখবেন দয়া করে ? শুনেছি আপনি বড়াে ডাক্তার ।

দেখলাম পাখির ছানাটিকে । পায়ে সত্যিই লেগেছিল । টিংচার আয়ােডিন লাগিয়ে বেঁধে দিলাম ।

কী করবেন এটাকে নিয়ে , পুষবেন ?

না । ভালাে হলে ছেড়ে দেবাে । জীবন্ত কোনাে জিনিস পােষবার সামর্থ্য নেই আমার । ইচ্ছে করে খুব , কিন্তু পয়সা নেই । সেই জন্যে বিয়েও করিনি।

কুণ্ঠিত দৃষ্টি তুলে একটু হেসে চাইলেন আমার দিকে ।

ও । এর আগে তাে দেখিনি আপনাকে , কোথায় থাকেন ?

অবিনাশবাবুর বাড়িতে । দিন সাতেক হলাে এসেছি।

 আর একবার কুষ্ঠিত দৃষ্টি তুলে চাইলেন । অবিনাশবাবু এখানকার নামজাদা উকিল একজন । অবিনাশবাবুদের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে

 বুঝি ?

না তেমন কিছু নয় । আমার এক দূর - সম্পর্কের ভাগনীর বন্ধুর শ্বশুর উনি । আসলে লােক খুব ভালাে । তাই দয়া করে থাকতে দিয়েছেন । আলােবাবু পাখির ছানাটি নিয়ে চলে গেলেন ।

 দিন কয়েক পরে অবিনাশবাবুর বাড়ি যেতে হয়েছিল । সেখানে আলােবাবুর সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল । দেখলাম তিনি একটি দিশি কুকুরের বাচ্চার পরিচর্যায় নিযুক্ত হয়ে আছেন । আমাকে দেখেই এক মুখ হেসে বললেন , বিনুবাবুর কুকুর এটি । কুকুর পােষার শখ আছে কিন্তু সেবা করতে জানেন না , দুটো চোখে এতক্ষণ পিচুটি ভরতি ছিল , তুলাে ভিজিয়ে পরিষ্কার করলুম । আর কুকুরকে সারাক্ষণ বেঁধে রাখলে কি চলে ?ওদের সঙ্গে খেলা করতে হয় -

কুকুরটার দিকে চেয়ে তার মুখের সামনে টুসকি দিতে লাগলেন । ল্যাজ নেড়ে নেড়ে খেলা করতে লাগল কুকুরটা । বিনু অবিনাশের ছেলে , বয়স দশ বছর । 

অবিনশবাবুর সঙ্গে দেখা হলো একটু পরে । 

বললাম , আপনার এই আলােবাবু লােকটি তাে অদ্ভুত ধরনের মনে হচ্ছে । 

হ্যাঁ , অদ্ভুতই । স্নেহের কাঙাল বেচারা । গরিবও খুব । আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছে নাকি ? 

হ্যাঁ , এক পাখি - পেশেন্ট নিয়ে গিয়েছিলেন আমার কাছে । 

দেখবেন তাে , যদি ওর চাকরি - বাকরি জুটিয়ে দিতে পারেন কোথাও । সেবা করতে বড়াে ভালােবাসে , বিশেষত সেবার পাত্র বা পাত্রী যদি অসহায় হয় -

দিন কতক পরে সিভিল সার্জনের সঙ্গে দেখা হলাে । একসঙ্গে কলেজে পড়েছিলুম । কথায় কথায় । আলােবাবুর কথা উঠে পড়ল । সিভিল সার্জন বললে , এখানকার হাসপাতালে ওকে প্রবেশনার ড্রেসার করে । ঢুকিয়ে নিতে পারি । তবে দশ টাকার বেশি এখন পাবে না । পরীক্ষায় পাশ করলে তখন মাইনে বাড়বে –

 আলােবাবু হাসপাতালের আউট-ডােরে রােগীদের ঘা ধোয়াতে লাগলেন । মাসখানেক পরেই কিন্তু চাকরিটি গেল তার । একদিন আমার ল্যাবরেটরিতে এসে শুষ্ক মুখে বসে আছেন ।

কী খবর -

আমাকে দূর করে দিলে ।

কেন ? 

একটা লােকের পায়ের ঘা কিছুতেই সারছিল না । সে - ই আমাকে একটা ওষুধ দেখিয়ে দিয়ে বললে , ওই ওষুধটা দাও – তাহলে সেরে যাবে । ওটা লাগিয়ে অনেকের নাকি সেরে গেছে । দিলুম ওষুধটা লাগিয়ে , প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লােকটা চিৎকার শুরু করে দিলে , সে এক হৈ - হৈ ব্যাপার ! ডাক্তারবাবু এলেন , তিনি তাে চটেই লাল , বললেন , কার হুকুমে তুমি ঘায়ে কাবলিক অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছ । আমি আর কী বলব , চুপ করে রইলাম । ডাক্তারবাবু আমাকে দূর করে দিলেন । আমি ওর ভালাের জন্যেই ওষুধটা দিয়েছিলাম আর ওর কথাতেই দিয়েছিলাম -

 আমি চুপ করে রইলাম , কী আর বলব ! সত্যিই অন্যায় কাজ করেছেন ।

কিছুক্ষণ বসে থেকে আলােবাবু চলে গেলেন ।

কষ্ট হতে লাগল ভদ্রলােকের জন্য , কিন্তু কী করব ভেবে পেলাম না ।

দিন কয়েক পরে অবিনাশবাবুর বাড়ি থেকেও বিদায় নিতে হলাে আলােবাবুকে । শুনলাম অবিনাশবাবুর স্ত্রী দুর করে দিয়েছেন তাঁকে । আলােবাবু যা করেছিলেন তা কোনও মা সহ্য করতে পারেন না । তিনি এক বগলে কুকুরের বাচ্চাটা এবং আর এক বগলে অবিনাশবাবুর শিশুপুত্র তিনুকে নিয়ে একবার কুকুরটার মুখে আর সঙ্গে সঙ্গে তিনুর মুখে চুমু খাচ্ছিলেন ।

 অবশেষে আমিই আশ্রয় দিলাম আলােবাবুকে ।

 একদিন সন্ধের পর এসে দেখলাম তিনি একটা সােলার হ্যাট বাজিয়ে গুন গুন করে গান গাইছেন।

আপনি গান - বাজনা জানেন নাকি - 

কুণ্ঠিতমুখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি । 

এককালে ডুগি - তবলা বাজাতে পারতাম । দৈন্যের দায়ে সব বেচে দিতে হয়েছে । এখন হ্যাট বাজাই – 

বলা বাহুল্য , খুব কৌতুক অনুভব করলাম । 

হ্যাট পেলেন কোত্থেকে  -

অনেক আগে স্যুটও পরতাম । সব গেছে , ওই হ্যাটটি আছে কেবল । 

আলােবাবুর আরও পরিচয় পেলাম দিন কয়েক পর । একদিন দেখি তিনি ছুটতে ছুটতে আসছেন ।

 কী হলাে , ছটছেন কেন –

দশটা বেজে গেছে আমার ঘড়িতে দম দেওয়া হয়নি এখনও । রামবাবুর গাইটার বাচ্চা হয়েছে শুনে দেখতে গিয়েছিলাম , হঠাৎ শুনতে পেলাম তার বৈঠকখানার ঘড়িতে টং টং করে দশটা বেজে গেল । তখুনি ছুটলাম , আমার ঘড়িতে ঠিক দশটার সময় দম দিই । আমাদের যেমন খাবার , ঘড়ির তেমনি দম , বেচারির খেতে দেরি হয়ে গেল আজকে – 

তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়লেন নিজের ঘরে । আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম । আলােবাবুর যে ঘড়ি আছে তা জানতাম না । তাঁর পিছু পিছু এসে একটু আড়াল থেকে দেখতে লাগলাম । দেখলাম ঘরে ঢুকেই তিনি নিজের ভাঙা তােরঙ্গটা খুললেন । তার ভেতর থেকে বার করলেন একটি ছােটো টিনের বাক্স । বাক্সের ভিতর থেকে একটা ন্যাকড়ার ছােটো পুটুলির মতন কী বার করলেন । ন্যাকড়াটি খুলতেই লালরঙের শালুর পুঁটুলি বেরিয়ে পড়ল । সেটি খুললেন । বেরুল রেশমি ন্যাকড়ার পুঁটুলি , সেটি খুলতেই বের হলাে খানিকটা তুলাে , তারপর ছােট্ট ঘড়িটি । তিন পুরু কাপড় - ঢাকা ঘড়িটিকে আঙ্গুলের মতাে রাখতেন তিনি সযত্নে । ঘড়িটি বার করে চাপটালি খেয়ে বসলেন , তারপর চোখ বুজে ধীরে ধীরে দম দিতে লাগলেন । মনে হলাে যেন পুজো করছেন ।

 অবিনাশবাবুর কথাটা মনে পড়ল । স্নেহের কাঙাল বেচারা । জীবনে কিন্তু ভালােবাসার সুযােগ পাচ্ছে না । কোথাও । সব স্নেহ তাই উজাড় করে দিয়েছে বােধহয় ঘড়িটির উপর ।

একদিন ল্যাবরেটরি থেকে ফিরে দেখি , আলােবাবু হাট বাজিয়ে তারস্বরে গান গাইছেন । দুটো লাইনই বার বার গাইছেন -

আমায় ওরা সইলাে না কেউ / আমার কাছে রইলাে না কেউ - 

আমি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম অবাক হয়ে । এমন গলা ছেড়ে গান গাইতে শুনিনি কখনও তাকে । দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে গেলেন তিনি ।

 আজ এত জোরে গান গাইছেন যে !

এমনি ।

তারপর আমার দিকে চেয়ে কুষ্ঠিত হাসি হেসে বললেন , আমার ঘড়িটা চুরি হয়ে গেছে । ঠিক সময় হয়তাে ভালাে করে দম দিতে পারবে না –

 টপ - টপ করে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা ।

আলােবাবু এখন পাগলা গারদে আছেন । সমাজের সঙ্গে নিজেকে তিনি খাপ খাওয়াতে পারলেন না কিছুতে ।



                         "(সমাপ্ত)"


             


৩টি মন্তব্য

  1. Valo
  2. Ar uttar ki
আপনাদের কোন প্রশ্ন থাকলে দয়া করে জানাবেন ।